ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

লেখকের অন্য চোখ
এক সময় নাটকের শেষে লাল আলো জ্বলত
সমরেশ মজুমদার

কলকাতায় বেড়াতে এসে প্রথম নাটক দেখেছিলাম ছাপ্পান্ন বছর আগে। বিশ্বরূপা থিয়েটারে ‘ক্ষুধা’ নাটকে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ কুমার, সুব্রতা সেনরা অভিনয় করেছিলেন। মফস্বলের সদ্য তরুণ তাদের অভিনয় দুই চোখ দিয়ে গিলেছিল। তার দুই বছর পর যখন পাকাপাকি কলকাতার করপোরেশনের জল পেটে পড়ল, তখন থেকে নাটক দেখার ভূত ঘাড়ে চাপল। এই করতে করতে বছর দশেক ‘দেশ’ পত্রিকায় সেই সময়কার সেরা নাটকগুলো নিয়ে যা ভেবেছি, তা লিখে গেছি। তারপর এক সময় একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হলাম। সেই ‘নবান্ন’ থেকে শুরু হয়েছিল। ‘নবান্ন’ অতিশয় প্রয়োজনের নাটক। কিন্তু তারপর সেই নবান্নকে ভাঙিয়ে একের পর এক গ্রুপ থিয়েটার অভাব বিক্রি করেছে বিভিন্ন মঞ্চে। দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষদের কষ্ট বিক্রি করেছে আর দর্শকরা সেই নাটক দেখতে গেছেন। পয়সা দিয়ে টিকিট কিনেছেন, না কষ্ট কিনেছেন তা নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। যারা নাটক দেখে আনন্দ পেতে চাইতেন তারা যেতেন শ্যামবাজারের থিয়েটারে। সেখানে বিধায়ক ভট্টাচার্য, দেবনারায়ণ গুপ্তরা নিশ্চয়ই ভালো গল্প বলতে চাইতেন কিন্তু দর্শক যেত উত্তম কুমার থেকে অপর্ণা সেন পর্দা থেকে নেমে এসে মঞ্চে যে অভিনয় করছেন, তা দেখতে। বাঙালি প্রতি বৃহস্পতি-শনিবারে ভিড় জমিয়েছেন সেখানে।  

ওদিকে ভালো নাটক না পেয়ে গ্রুপ থিয়েটার আঁকড়ে ধরেছে বিদেশি নাটকে। তার ভাবানুবাদ, অনুসরণে টিকে থাকতে চেয়েছে।  পাশাপাশি মনোজ মিত্র এবং মোহিত চট্টোপাধ্যায় আশার আলো দেখাচ্ছেন। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের সামগ্রিক সমুদ্রে সেই বাতিঘর আর কতটুকু আলো দিতে পারে! আর ছিল অফিস ক্লাবের থিয়েটার, যাকে অবলম্বন করে অনেক মানুষের সংসার চলত। কেদার রায়, বঙ্গে বর্গী ইত্যাদি নাটকে গলা ফুলিয়ে সংলাপ বলতেন অফিসের বাবুরা, মহিলা চরিত্রে পেশাদার অভিনেত্রীরা, যাদের সব সংলাপ মুখস্থ থাকত। ঐতিহাসিক নাটকের চাহিদা বেশি ছিল, সামাজিক নাটকের মধ্যে দুই পুরুষ থেকে বউদির বিয়ে— গদগদে পারিবারিক গল্প। তখন সংলাপ মুখস্থ করে মঞ্চে উঠে তা উগরে দিলেই হাততালি, তাই নাটক। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এই চোরাবালি থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। ‘রক্তকরবী’ থেকে পুতুল খেলা, কল্লোল থেকে তিতাস, নাট্যকারের সন্ধানে থেকে পাপপুণ্য অন্য খাতের নাটক, যা করার ক্ষমতা বেশির ভাগ দলের ছিল না। এবং তার মধ্যে চাকভাঙ্গা মধু থেকে শোয়াইক বা দায়বদ্ধ কিংবা মারীচ সংবাদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বলতে হবে বাংলা নাটক মানে মঞ্চে গল্প বলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। দুই পাশের উইংস দিয়ে কুশীলবরা মঞ্চে প্রবেশ করবেন। কথা বলবেন। সেই মঞ্চে বসার ঘর, শোয়ার ঘর ছবির মতো আলাদা আলাদা থাকত। তারপর নতুন রীতি চালু হলো। যা শোয়ার ঘর তাই রাস্তা করে দেখানোর সাহস দেখালেন পরিচালকরা। এমন কি অভিনয় চলার সময় সেট সাজানোর লোকজন মঞ্চে ঢুকলেও দর্শকরা সেটা উপেক্ষা করতেন। এক সময় নাটকের শেষে লাল আলো জ্বলত। বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের নিন্দুকরা তাকে ‘লালবাতি’ বলতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাত্য বসু যখন নাটক শুরু করলেন তখন তার পক্ষে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু উইঙ্কল থেকে বোমা নাটক যে স্রোতের অন্য ঢেউ থেকে আলাদা চেহারা নিচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু আচমকা মেঘ সরিয়ে আকাশ দেখালেন ব্রাত্য মুম্বই নাইটস তৈরি করে। মনে আছে সাতাশি সালে যখন লন্ডনে যাই তখন নাটক দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। মঞ্চকে ওভাবে ভেঙেচুরে ব্যবহার করা যায়, হইহই করে পাত্র-পাত্রীরা শরীরের কসরত এবং অভিনয়কে মিশিয়ে ফেলতে পারে এবং দুই ঘণ্টার নাটকের শেষে দর্শকদের মনে হবে আরে, কী দেখলাম, ওই অনুভূতিটা কেন বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে হয় না।  কেন শুধু কথার কচকচি বা সমস্যার বোঝা টানা নাটক দেখতে বাধ্য হবেন দর্শকরা। কেন তারা পয়সার বিনিময়ে বিনোদন পাবেন না। আক্ষেপ ছিল। খুব।  শেকসপিয়র সাহেবের ‘টুয়েলভথ নাইট’ অবলম্বনে এই বিনোদনটির নাম ‘মুম্বই নাইটস’ সাহস, দুঃসাহসের বাইরে আরও শক্তিশালী কোনো শব্দ যদি থাকত তা হলে সেটাও এই প্রযোজনার ক্ষেত্রে কম বলে মনে হতো। ছাপ্পান্নটি চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নির্বাচন করে প্রথমে তাদের রোবট করেছেন ব্রাত্য। রোবটদের গান এবং শারীরিক কসরত শিখিয়েছেন। তারপর তাদের প্রাণদান করেছেন। ফলে তারা মুম্বই নাইটসেরই চরিত্র হয়ে গেছেন। যতক্ষণ না শেষ হয়েছে ততক্ষণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিজস্ব পরিচয় ছিল না। একটি পানশালাকে কেন্দ্র করে টানা গল্প শোনাননি নাট্যকার দেবাশিস বা নির্দেশক ব্রাত্য বসু। গল্প দানা বাঁধার মুহূর্তেই তা ভেঙে দিয়েছেন। আবার অবলীলায় কয়েকটি দৃশ্যের পরে গল্পটাকে টেনে এনেছেন।  এই কাহিনী মুম্বইয়ের পটভূমিকায়। ফলে হিন্দি সংলাপ এসেছে স্বাভাবিকভাবেই। বাংলা আনতে হয় তাই। আবার যে দৃশ্যে প্রেমিকের চলে যাওয়া দেখে উষ্ণতা ষাটের দশকের নায়িকার মতো পিয়ানো বাজিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান ‘আরও কিছুক্ষণ না হয় রইতে কাছে’ গেয়ে উঠল তখন বুকের ওপর কেউ যেন সুখের হাত বোলাল।  এই প্রযোজনা ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে সংগীত এবং আলো ব্যবহারের জন্য। দীনেশ পোদ্দার, সাধন পাড়ুই, শুভদীপ গুহ, দিশারি চক্রবর্তীদের সঠিক নির্বাচন করেছেন ব্রাত্য এবং তারা নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করেছেন।  অভিনয় কেউ করেননি। সবাই একেকটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন। উষ্ণতা ফুল ওসমানিতে মিশে গেছেন অনন্যা পাল ভট্টাচার্য। কে নয়? সুমন্ত রায়, সুমিত দত্ত, রায়তী বসুদের জন্য অভিনন্দন রইল। আর গৌতম হালদার। তিনি যে ক্ষমতাবান অভিনেতা তা আমরা বহুদিন ধরে জানি। কিন্তু এই প্রযোজনায় আমি গৌতম হালদারকে খুঁজে পাইনি। পেয়েছি রক্ত-মাংসের টিক্কা আলমকে। বাংলা নাটকে এমন কাজ আর কেউ করেছেন কিনা জানি না। যেভাবে চরিত্রগুলো নেচেছে, গান গেয়েছে এবং চৌকস হিন্দি বলেছে, তা চমকে দেওয়ার মতো। ‘নবান্ন’ থেকে বাংলা নাটক একটা মোড় নিয়েছিল। ‘মুম্বই নাইটস’ বাংলা নাটককে সাবালক করল। এত বড় বৃক্ষ তৈরি করলেন ব্রাত্য, এই কাম্য, এই বৃক্ষ বাগান তৈরি করুক।  ব্রাত্য বসু, আপনি আমাদের আকাঙ্ক্ষা আরও বাড়িয়ে দিলেন। 

লেখক : বিশিষ্ট কথাশিল্পী

 

বিডি-প্রতিদিন/ ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা



এই পাতার আরো খবর