ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

সারেন্ডার ডকুমেন্টের খসড়া জেনারেল জ্যাকবের
ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম (অব.) এমপি
ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম (অব.) এমপি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের (অব.) মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারাল। তিনি ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। জেনারেল মানেকশ জ্যাকবের ওপর সামরিক দক্ষতা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গভীর আস্থা রেখেছিলেন। তিনিও সেই আস্থার পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়েছিলেন। ডিসেম্বরে বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হলেও এপ্রিল থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করেছে। জেনারেল জ্যাকব সে সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে অস্ত্র সরবরাহ করাসহ ঘুরে বেড়িয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য সাহস জুগিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর সব সময় জেনারেল জ্যাকবের কাছ থেকে সরাসরি নিতেন। পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা এবং সারেন্ডার ডকুমেন্ট যা তৈরি করা হয়েছিল, তার ড্রাফট করেছিলেন জেনারেল জ্যাকব।   ১৬ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেল নিয়াজি যখন টালবাহানা শুরু করেন, জেনারেল জ্যাকব তখন আধা ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। এরপর বিকালে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ঢাকা ছিল ভূ-রাজনীতির দিক দিয়ে কেন্দ্রস্থল। ঢাকাকে যদি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়া সহজ হয়। যুদ্ধের ফল নিজেদের পক্ষে আসে। জেনারেল জ্যাকব পুরো কৌশল এমনভাবে নিরূপণ করেন, যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের আরও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতো পারত। কিন্তু জেনারেল জ্যাকবের বুদ্ধিমত্তার কারণেই মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। জেনারেল জ্যাকব ছিলেন চিরকুমার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাকে শুধু সমরাস্ত্রবিদ্যাই এতদূর নিয়ে যায়, তা নয়। তার বাংলাদেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও প্রেম থাকার কারণেই তাকে উন্নতির আসনে নিয়ে আসে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সে দেশের জনগণ কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা করতে এসেছিল। কোনো দেশ দখল করতে নয়, ন্যায্য অধিকার ও একটি দেশকে পরাধীনতামুক্ত করতে এসেছিল। এ কারণে তাদের মনোবল ছিল চরম চাঙ্গা। ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ৮৩ জন বিদেশি নাগরিককে যে সম্মাননা প্রদান করা হয়, তার মধ্যে জেনারেল জ্যাকব ছিলেন অন্যতম। সম্মাননা গ্রহণ শেষে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারাই। তাদের সাহস ও দেশপ্রেমের কারণেই জয়ী হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল চালিকা ছিল মুক্তিবাহিনীর হাতেই।’ এই যে অকপটে সত্যটা বলা, সেটা সম্ভব হয়েছে কেবল উদারতার কারণেই। সাধারণত মহৎ মনের অধিকারী না হলে এমন কথা বলেন না। কারণ অনেকেই নিজের গৌরবের ও কৃতিত্বের কথা প্রকাশ করতে চান। কিন্তু জেনারেল জ্যাকব সত্যিটা তুলে ধরেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক দেশ ও ব্যক্তি আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু ভারতীয় জনগণ ও জেনারেল জ্যাকবের নাম স্মরণীয় ও উজ্জ্বল থাকবে। থাকবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তাকে হারিয়ে আমরা বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধুকে হারিয়েছি। তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি, তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। বাংলাদেশে যখনই মুক্তিযুদ্ধের কথা আসবে, তখনই তার নাম উচ্চারিত হবে।   অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি


এই পাতার আরো খবর