ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

তাহলে কোথাও কি কোনো খেলা চলছে?
শওগাত আলী সাগর

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যতটা তাণ্ডব হয়েছে, ঘটনা নিয়ে ঠিক ততটা কথাবার্তা হয়নি, হচ্ছেও না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজড়িত সংগীত প্রতিষ্ঠানটি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার ছবি দিয়ে কেউ কেউ আহাজারি করার চেষ্টা করেছেন। সেই আহাজারিগুলোও কেমন যেন গুটিকয় অক্ষমের আর্তনাদের মতোই মনে হয়েছে। যেন ব্যাপারটা গুটিকয়েকের মনোবেদনার বিষয়, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের তথা রাজনীতির কোনো বিষয় নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবটি কি আসলেই রাজনীতির কোনো বিষয় নয়? রাজনৈতিক বিষয় হলে এ ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বড় ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই কেন? সরকারেরই বা প্রতিক্রিয়া কী? সত্যি বলতে কী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কী ঘটেছে, তার চেয়ে ওই ঘটনা নিয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়াটুকু জানার ব্যাপারে বেশি কৌতূহলী ছিলাম। একটি জেলা শহরে একজন মাদ্রাসাছাত্র নিহত হয়েছেন, প্রকাশ্য দিবালোকে দলবেঁধে একটি গোষ্ঠী শহরের রেল স্টেশন, হাসপাতাল, সংগীত প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করেছে— এ নিয়ে রাষ্ট্রের তথা সরকারের কোনো বক্তব্য থাকবে না, কোনো ব্যাখ্যা থাকবে না— তা কী করে হয়! আমাদের রাজনীতিকরা, মন্ত্রীরা এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি বক্তৃতায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলেন, আগুনসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলেন। অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্ত্রাস রাজনীতিকদের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে তেমন একটা গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই তাণ্ডব কেন ঘটল তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো চিত্রও সম্ভবত আমাদের কাছে নেই। ঢাকার মিডিয়াগুলো ঘটনার সূত্রপাতের যে বিবরণ দিয়েছে, তা-ও কেমন যেন সামঞ্জস্যহীন। কোনো কোনো মিডিয়ার তথ্যে দেখা যায়, রাস্তায় গাড়িতে কোনো এক মাদ্রাসাছাত্রের সঙ্গে কথাকাটাকাটি থেকে ঘটনার সূত্রপাত। পরে দলবেঁধে মাদ্রাসাছাত্রদের দোকানে হামলা। আবার কিছু মিডিয়া খবর দিয়েছে, মোবাইল কেনা নিয়ে কথাকাটাকাটি, পরে মাদ্রাসাছাত্রদের দলবেঁধে হামলা। পত্রপত্রিকা সামঞ্জস্যহীন খবর দিলেও একটি ক্ষেত্রে তাদের পরিবেশিত সংবাদের মিল আছে। সেটি হচ্ছে, মাদ্রাসাছাত্ররা দলবেঁধে মার্কেটে হামলা চালিয়েছিলেন। একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বা মার্কেটে যদি কোনো গোষ্ঠী বা গ্রুপ দলবেঁধে হামলা চালায়, তবে সেটি অবশ্যই একটি অপরাধ। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যকে বিবেচনায় নিলে মাদ্রাসার ছাত্ররা বেআইনি কাজ করেছেন, অপরাধ করেছেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের আইনবহির্ভূত তত্পরতার জেরে যদি এই তাণ্ডবের ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অথচ পুরো ঘটনাটিই যেন ‘কিছুই ঘটেনি’ বলে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিন্তু আমরা ‘কিছু ঘটেনি’ বলে ‘ঝেড়ে ফেলার’ চেষ্টা যতই করি না কেন, ব্যাপারটা কি এমনিতেই মিটিয়ে যাবে? যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের এতটা বোকা ভাববার কারণ আমি দেখি না। ইতিমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মোবারক উল্লাহ ‘ভয়াবহ’ কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত সোমবার মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের নির্দেশে জেলার নাসিরনগরের ধনপুরা এলাকার একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে ওই দিন দুপুরে কওমি ছাত্র ঐক্য পরিষদ শহরে মিছিল-সমাবেশ করে। মিছিল-সমাবেশ করাকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যায় পরিকল্পিতভাবে জেলা পরিষদ মার্কেট এলাকায় মাদ্রাসাছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়। (সূত্র : এনটিভি অনলাইন)। এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং মারাত্মক অভিযোগ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনটির খবর পরিবেশন করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় সাংবাদিকরা। মোবারক উল্লাহর সংবাদ সম্মেলনের খবর অধিকাংশ পত্রিকা প্রকাশ করলেও তার এ অভিযোগ অনেক পত্রিকা প্রকাশ করেনি। কিন্তু বিএনপি- জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল মিডিয়াগুলো ঠিকই স্পর্শকাতর ও আপত্তিকর এ বক্তব্যটুকুও প্রচার করেছে। তা ছাড়া সারা দেশে তাদের ‘মাউথ অব ওয়ার্ড’ নেটওয়ার্কে এ বক্তব্যটা যে ছড়িয়ে পড়ছে না, তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারেন? পারবেন না। তাহলে কী দাঁড়াল? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবের ব্যাপারে রাজনীতি এবং রাষ্ট্র নীরব ভূমিকা নিলেও এ নিয়ে অপপ্রচার ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপই কিন্তু নেওয়া হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদ্রাসা যে বক্তব্যটি এখন সারা দেশে প্রচার করছে, তা হলো সরকারের একজন মন্ত্রী ওই এলাকায় একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদ্রাসাছাত্ররা তার প্রতিবাদ করেছেন, তাই পুলিশ মাদ্রাসায় ঢুকে একজন ছাত্রকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। ঘটনা কি আসলে তাই? নাসিরনগরে কি আসলেই কোনো মসজিদ বা মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? না দেওয়া হয়ে থাকলে মোবারক উল্লাহ এমন একটি অভিযোগ কীভাবে তুললেন? কীসের ভিত্তিতে তুললেন? এগুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে তাণ্ডব হয়েছে, তা কিন্তু রাতের অন্ধকারে কিংবা গোপনে হয়নি। প্রায় সব কটি পত্রিকায়ই হামলাকারীদের ছবি ছাপা হয়েছে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ দাবি করেছেন, ‘মাদ্রাসার ছাত্ররা নয়, দুষ্কৃতিকারীরাই মাদ্রাসাছাত্রদের নামে এ হামলা চালিয়েছে।’ লম্বা পাঞ্জাবি পরিহিত, টুপি-পাগড়িওয়ালা যাদের ছবি আমরা পত্রিকায় দেখেছি তারা অবশ্যই দুর্বৃত্ত। তারা মাদ্রাসার ছাত্র হলেও দুর্বৃত্ত। কিন্তু টুপি-পাগড়িওয়ালা এই দুর্বৃত্তরা আসলে কারা, তা চিহ্নিত হওয়া দরকার। ছবি দেখে দেখে তাদের শনাক্ত করা কঠিন কিছু নয়। সরকারের গোয়েন্দারা যেমন কাজটি করতে পারেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদ্রাসাও দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করতে পারে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যেহেতু দাবি করছেন, এই ‘টুপিওয়ালা- পাগড়িওয়ালারা’ মাদ্রাসার কেউ নয়, তাহলে পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে দেখে তারাও তাদের শনাক্ত করে পরিচয় প্রকাশ করতে পারেন। তা করাই উচিত হবে। সরকারের গোয়েন্দা কিংবা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ— কেউই এ কাজটি করবেন কিনা, তা আমাদের পক্ষে বলা কঠিন। কিন্তু মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে একটি সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ধরে এগোচ্ছে এবং খুবই সক্রিয়ভাবে এগোচ্ছে, তা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য থেকেই আঁচ করা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সরাসরি ‘ধর্মের কার্ড’ খেলতে শুরু করেছে এবং সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার মতো বক্তব্য দিয়েছে।

আচ্ছা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ তাণ্ডবটি যদি ছাত্রলীগের ছেলেরা করত? তাহলে উপায় ছিল না। এতক্ষণে ‘গেল গেল’ রব তুলে আমাদের সুশীল-কুশীল, মিডিয়া, রাজনীতিক সবাই মিলে একটা শোরগোল তুলে ফেলতেন। এ ঘটনাটি যদি বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলের ছেলেরা করত, তাহলেও প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা এতক্ষণে কথার বন্যা বইয়ে দিতেন। কিন্তু মাদ্রাসাছাত্রদের এ তাণ্ডবের ব্যাপারে সব মহলেরই কেমন যেন একটা প্রশ্রয়সূচক নীরবতা দৃশ্যমান। তার কারণ কী? কোথাও কি খেলা চলছে তাহলে? আমরা বাঘা বাঘা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করব, আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, চট্টগ্রামে মাদ্রাসা, হেফাজতের নামে ধর্মীয় উন্মাদনাকে নীরবে সমর্থন দিয়ে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুক্তচিন্তার বিকাশকে হুমকির মধ্যে রাখব! একে দিয়ে ওকে, ওকে দিয়ে একে ব্যালান্সে রাখার সর্বনাশা কোনো খেলার অংশীদার আমরা হয়ে উঠিনি তো?

লেখক : টরন্টোর (কানাডা) ‘নতুনদেশ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।



এই পাতার আরো খবর