ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

কলকাতার চিঠি
দিল্লিতে দাদা ও কলকাতায় দিদি
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

দিল্লিতে দাদা। আর কলকাতায় দিদি। হঠাৎ কেন গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ক্ষুব্ধ হলেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে শিক্ষকসমাজের কাছে একটাই উত্তর— এরা দুজনেই শিক্ষাজগতে খুব বেশি দূর যেতে পারেননি। বঙ্গের দিদি একবার বলেছিলেন তিনি আমেরিকার জর্জিয়ার ফিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। খবরটি প্রকাশ হওয়ার পর সংবাদপত্রের তদন্তে দেখা যায় ওই নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জর্জিয়ায় ছিল না। এখনো নেই। আর নরেন্দ্র মোদি ছাত্রজীবন থেকেই আরএসএস প্রচারক। তিনিও প্রথাগত শিক্ষায় বেশি দূর এগোননি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিতরের ব্যাপার তারা খুব একটা জানেন না বলেই মনে হয়। মমতা বেছে বেছে দলের ঘনিষ্ঠদের উপাচার্য করেছেন। আর নরেন্দ্র মোদি চাইছেন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে গৈরিক ভাবধারা চালু করতে। বছর দুয়েক আগে দিল্লির একটি ইংরেজি চ্যানেলে দর্শকাসনে প্রেসিডেন্সির এক ছাত্রীর প্রশ্ন শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে গিয়েছিলেন দিদি। ওই ছাত্রীকে মাওবাদী বলে গালমন্দ করে চলে যান। মোদি আর তার দল জওহরাল নেহরু ইউনিভার্সিটি (জেএনইউ)সহ সর্বত্র আরএসএসের ভাবধারা প্রচার করছেন। আর দিদি রাজ্যে তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে ঢোকাতে চাইছেন। দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য এনেছেন দাদা-দিদি। গত মঙ্গলবার তাতে যুক্ত হয়েছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ও।

জেএনইউর মতোই ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পেটানো হলো বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। বস্তুত, এ ঘটনা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাপিয়ে গেছে। তার কারণ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি কানহাইয়া কুমারকে গ্রেফতার করতে পুলিশ দিল্লিতে জেএনইউ ক্যাম্পাসে ঢুকলেও ছাত্রছাত্রীদের এভাবে লাঠিপেটা করেনি। কিন্তু বর্ধমানে যে ঘটনা ঘটল তা সাম্প্রতিককালে নজিরবিহীন। বর্ধমানের এসডিপিও সৌমিক সেনগুপ্তের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী আন্দোলনরত এসএফআই সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনকি পুরুষ কর্মীরাও মহিলাদের ফেলে পেটান। ৩০ জন ছাত্রছাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১১ জন এখনো হাসপাতালে ভর্তি। এ ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলনে নেমেছে এসএফআই। এসএফআই সাধারণ সম্পাদক বিক্রম সিংয়ের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল বর্ধমান মেডিকেল কলেজে গিয়ে আহতদের সঙ্গে কথা বলেন।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টুইট করে রাজ্যের বিরোধী দল নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ওপর পুলিশ যে রকম নির্মমভাবে লাঠি চালিয়েছে তার নিন্দার কোনো ভাষা নেই।’ অন্যদিকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরও ভূমিকার নিন্দা করে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসের ভিতর পুলিশ ডেকে এনে এ উপাচার্য জেএনইউর উপাচার্যের মতোই নিন্দনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। আমরা ছাত্রছাত্রীদের ন্যায়সংগত দাবির পাশেই আছি। এই তৃণমূল কংগ্রেসকে উত্খাত করতে ঐক্যবদ্ধ হোন এবং লড়াইয়ে নামুন।’ দীর্ঘদিন ধরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকমতো রেজাল্ট বের হচ্ছে না। সে কারণে ঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল এসএফআই। সেই মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজবাটী ক্যাম্পাসে ঢুকতে গিয়ে তারা দেখে লোহার গেটের তালা বন্ধ। গেট টপকে বহু ছাত্রছাত্রী উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকারের ঘরের সামনে বিক্ষোভে শামিল হন। উগ্রতৃণমূলী বলে পরিচিত স্মৃতিবাবু গোড়ায় বলেন, দশজন ছাত্রের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করবেন। পরে খবর পাঠান দশজন নয়, চারজনের সঙ্গে কথা বলতে রাজি আছেন। এরই মধ্যে তিনি ফোনে পুলিশ ডেকে পাঠান। পুলিশ গেট খুলে ভিতরে ঢুকে লাঠিপেটা শুরু করে। পুরুষ পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয় ছাত্রীদেরও। ছাত্রছাত্রীদের ওপর লাঠিপেটার এই ছবি টেলিভিশনে দেখে গোটা দেশ শিহরিত হয়ে ওঠে। পরে এসএফআইর রাজ্য সভাপতি মদুজা সেনরায় বলেন, ‘এই উপাচার্য মিথ্যাবাদী, ভণ্ড। ওর উপাচার্যের পদে বসে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। ওকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। না হলে আরও বৃহত্তর আন্দোলনে নামা হবে।’ এসএফআইসহ অন্য বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো বুধবার রাজ্যজুড়ে ধিক্কার দিবস কর্মসূচি পালন করেছে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, কী ঘটনা ঘটেছিল তা পুরোপুরি জেনে তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমারের গ্রেফতারি ও হায়দরাবাদ বিদ্যালয়ের গবেষক-ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে একাডেমির সামনে রানুচ্ছায়া মঞ্চে প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী সঙ্ঘের সদস্যরা। সংগঠনের যুগ্ম-সম্পাদক পার্থ রাহা ও রজত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বাকস্বাধীনতার ওপর যে ভয়াবহ আক্রমণ চলছে তার নবতম সংযোজন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আরএসএস আশ্রিত ফ্যাসিবাদী দুষ্কৃতদের তাণ্ডব। দিল্লির জেএনইউ ও যাদবপুরে অসহিষ্ণুতার ঘটনায় স্তম্ভিত রাজ্যবাসী।

এদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গান, কবিতা, বক্তৃতার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে হানাদারির বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। জেএনইউর ঘটনা, স্বাধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসের মধ্যেই সভা করেন তারা। সেখানে বক্তারা বলেন, বাইরের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ নয়, আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার এবং সহিষ্ণুতা বজায় থাকে। স্বাধিকার ক্ষুণ্ন হলেই মানবতাবিরোধী সব শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার সাহস পায়।

বিডি-প্রতিদিন/২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/মাহবুব



এই পাতার আরো খবর