ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

লেখকের অন্য চোখ
মনে হলো ঠিকঠাক একজন দাদা পেয়েছি
সমরেশ মজুমদার
গয়েরকাটা চা বাগান থেকে জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার দূরত্ব বড়জোর ৩৫ মাইলের। স্কুল শেষ করে আমার সহপাঠীদের মতো এসি কলেজে পড়ে চা বাগানে একটা চাকরি জুটিয়ে নিলে ওই ৩৫ মাইল খুব বেশি হলে একশতে পৌঁছত। আর সেই গণ্ডিতেই কেটে যেত গোটা জীবন। সকাল-বিকালে তিস্তার বাঁধে হেঁটে সূর্যকে উঠতে এবং ডুবতে দেখতাম। কিন্তু আমার জন্য অন্য চিত্রনাট্য লেখা ছিল। জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা, হোস্টেলে-মেসে অন্যের কৃপায় অফিস ঘরে রাত কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি গল্প-উপন্যাস লিখে ফেললাম। আবার সেই লেখা নিয়ে ছবি করতে এলো শংকর ভট্টাচার্য নামে এক তরুণ পরিচালক। প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ নিয়ে ছবি করেছিল সে। উনিশশো ঊনআশিতে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ছবির বাংলা রাইট নিয়েছিলেন প্রযোজক। জানা গেল শংকর আমার হোস্টেলের পাশের ঘরের বাসিন্দা অসীমের বন্ধু। ফলে সম্পর্ক গভীর হলো। অবশ্য ‘দৌড়’ ছবি শুরু হওয়ার আগে কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যাদের জলপাইগুড়িতে থাকার সময়ে আমরা নক্ষত্র বলে ভাবতাম। তারা তা ছিলেনও। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্রকে নক্ষত্র বলবেন না এমন কোনো বাঙালি আছে কি? ধীরে ধীরে বাংলার নক্ষত্রদের সঙ্গে জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় সেই অবাক হয়ে থাকা ছেলেটির শুধু যোগাযোগই তৈরি হলো না, একটা আলতো সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। এতদিন উত্তরবঙ্গ সংবাদের এ কলামে ছিল উত্তরবঙ্গের স্মৃতির মিছিল, এখন থেকে চেষ্টা করব এদের কথা লিখতে। যেমন দেখেছি। শংকর একদিন এসে বলল, ‘তোমাকে একবার টালিগঞ্জে যেতে হবে ভাই’। সে সময় মেট্রোরেল ছিল না যে শ্যামবাজার থেকে টালিগঞ্জ আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। দুবার বাস পাল্টাতে হবে অথবা ট্যাক্সি ভরসা। উদ্দেশ্য কী তা শংকর বলল না। শুধু জানাল এক ভদ্রলোক আলাপ করতে চাইছেন।   এখনো মনে আছে, টালিগঞ্জের বাঙ্গুর হাসপাতালের পাশে রাধা স্টুডিউর সামনে দিয়ে শংকর আমাকে নিয়ে পৌঁছেছিল গলফক্লাব রোডে। তখন শেষ দুপুর। একটি বিশেষ বাড়ির দরজায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাদের দেখে ভিতরে চলে গেলেন। শংকর বলল, ‘এসো’। চিলতে বারান্দা দিয়ে দরজায় যেতেই আমি চমকে উঠলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাদের দেখে ডিভানে বসা মানুষটি গলা তুলে বললেন, ‘আরে, আরে, এসো, এসো শংকর। যদি অনুমান ভুল না হয় তাহলে তোমার সঙ্গে যিনি এসেছেন তার নাম কি সমরেশ মজুমদার?’ আবার চমক। উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ, গায়ের রং প্রায় সোনার মতো। পরনে গেঞ্জি এবং পাজামা। শংকর মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, অনিলদা।’ আমি অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে, তার সামনে। জলপাইগুড়ির হয় রূপশ্রী নয় আলোছায়াতে তপন সিংহের ‘কালামাটি’ ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্রে অনিল চট্টোপাধ্যায়কে প্রথম দেখেছিলাম। সে সময় আমি কিশোর, বাড়িতে লুকিয়ে সিনেমা দেখতাম সওয়া পাঁচ আনার টিকিট কেটে। কখনো হাফ টাইমের পর ঢুকে ফাঁকা সিটে বসে পড়তাম পয়সা না থাকলে। সেই ছবির ছিপছিপে সুদর্শন চট্টোপাধ্যায়কে তারপরে একের পর এক ছবিতে দেখে নিয়েছি। একটা সময় এসেছিল যখন দর্শকরা তর্ক করতেন, কে বড় অভিনেতা? উত্তমকুমার না অনিল চট্টোপাধ্যায়। যেহেতু উত্তমকুমারের মতো রোমান্টিক নায়কের চরিত্রে বেশি অভিনয় অনিল চট্টোপাধ্যায় করেননি, তাই জনপ্রিয়তার নিরিখে তিনি পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় প্রথমবার এসে ইন্দিরা সিনেমায় ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল উনি খুব বড় অভিনেতা। ওই ছবি দেখতে যাওয়ার সময় শিবুদা সঙ্গে ছিলেন। কলকাতার মানুষ। জলপাইগুড়িতে দিদির বাড়িতে যেতেন বলে পরিচয় হয়েছিল। পরের দিন ছিল রবিবার। বললেন, ‘চলো, তোমাকে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিই।’ নিয়ে গেলেন সকাল ১০টায় বসুশ্রী সিনেমার উপরের কফি হাউসে। অনেকেই টেবিলে টেবিলে আড্ডা মারছিল। শিবুদা বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, ‘অনিল চট্টোপাধ্যায় আউটডোরে শুটিং করতে গিয়েছেন বলে আসেননি। নইলে রবিবারের সকালে বসুশ্রীর আড্ডা কামাই করেন না। সেদিন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যখন অনিলদা বললেন, ‘আপনার বয়স তো ৪০ হতে ঢের দেরি, এরই মধ্যে উত্তরাধিকারের মতো উপন্যাস লিখছেন কী করে?’ আমি আবার অবাক। তখন সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ওই উপন্যাস ধারাবাহিক বের হচ্ছিল। উনি না হয় সেটা পড়েছেন কিন্তু আমার বয়স জানলেন কী করে! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি পড়েছেন?’ ‘অবশ্যই। প্রত্যেক শনিবারে ওটা না পড়লে ভাত হজম হবে না।’ অনিলদা কথাগুলো বলেই একটু হাসলেন। ‘তোমাকে যদি ভাই ভেবে নিই তাহলে তুমি বলব।’ ‘আপনি আমাকে তুমি বললে খুশি হবো।’ তারপর যে কারণে শংকর নিয়ে গিয়েছিল তা জানতে পারলাম। ‘দৌড়’ ছবিতে তিনি একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন। উপন্যাস পড়ে উনি যা ভেবেছেন তার সঙ্গে আমি একমত কিনা জানতে চাইলেন। দেখলাম উনি সঠিক ভেবেছেন। তারপর বউদি এলেন, চা এলো। বেরোলাম যখন তখন মনে হলো আমি ঠিকঠাক একজন দাদা পেয়ে গেছি। অন্য একটি ছবির শুটিং করতে যাবেন বোলপুরে। আমাকে সঙ্গে নিলেন। সেখানে গিয়ে অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের পাশে শিল্পী অনিল চট্টোপাধ্যায়কে আবিষ্কার করলাম। দারুণ ছবি আঁকতেন। স্কেচের হাত ছিল খুব ভালো। একদিন শুটিং না থাকায় আমরা খাল পেরিয়ে তালতোড় গ্রামের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। বহুদূরে একটি বালককে ক্যান হাতে হেঁটে আসতে দেখে দৃশ্যটা এঁকে ফেললেন। দুপুরে গ্রাম্যপথে বালকের ছবিটি অপূর্ব। বালক কাছে আসতেই অনিলদা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ ‘বোলপুর বাজারে। বাবার জন্য নিয়ে যাচ্ছি।’ ছেলেটি জবাব দিল। ‘দুপুরের ভাত নিয়ে যাচ্ছ?’ অনিলদার প্রশ্ন। বালক মাথা নেড়েছিল , ‘না। মা তাড়ি পাঠিয়েছে নইলে বাবা মারবে।’ বালক চলে গেল। হঠাৎ দেখলাম অনিলদার দু-চোখ দিয়ে জলের ধারা নামছে। চোখ বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাচ্ছেন।


এই পাতার আরো খবর