ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

ফুটবলে আমাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা
কাজী সালাহউদ্দিন

সেই ছেলেবেলা থেকে ফুটবল মিশে আছে আমার রক্তে। আজ পেছনে ফিরলে মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। স্কুলে পড়ার সময় খেলা নিয়ে কত তোড়জোড়, কত আবেগ। সেসব দিন আমাকে স্মৃতিকাতর করে। প্রায় ষাট হাজার দর্শক রেখে ফুটবল মাঠ থেকে আমি বিদায় নিয়েছিলাম। সেই দর্শক দিনে দিনে কমেছে। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের পরিবার অবস্থাপন্নই ছিল। তখনকার দিনেই আমাদের গাড়ি ছিল। আমিও ছিলাম বেশ আদরের দুলাল। কিন্তু ফুটবল খেলতে চাইলে তো আদরের দুলাল সেজে ফুলবাবু হয়ে থাকার সুযোগ নেই। এখানে নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হয়। সে চেষ্টাই হয়তো বহুদূর টেনে এনেছে আমাকে। আমার পরিবারের সহযোগিতাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। একদিন নাক ফেটে গেল খেলতে গিয়ে। ভয়ে ভয়ে বাসায় এলাম। আম্মা অনেক রাগারাগি করলেন। কিন্তু আব্বা বললেন, খেলতে গেলে এমন হবেই। এই যে আব্বার দিক থেকে খেলার জন্য সবকিছু মাফ, সেটাও আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিয়েছে অফুরান সাহস। কিন্তু আমি একটু ঘাড়টেড়া ধরনের ছেলে ছিলাম। মুক্ত বাতাস চাইতাম নিরন্তর। ‘মুরগির খোপে’ আটকে থাকার লোক আমি নই। খোলা জায়গায় দাবড়ে বেড়িয়েছি শৈশব-কৈশোরে। এ কারণে আম্মার হাতে অনেক মার খেয়েছি। আমার অন্য কোনো ভাইবোনই এর জন্য মার খায়নি। এটা শুনে আবার ভাববেন না, আম্মা আমাকে পেছনে টেনে ধরে রাখতে চাইতেন। আসলে মা-বাবা কখনো আমার খেলোয়াড়ি জীবনে বাধার দেয়াল তোলেননি। ছোটবেলায় খেলা দেখতে যাব, আব্বার কাছে টাকা চাইলে সঙ্গে সঙ্গে বের করে দিতেন। অন্য কিছু চাইলে হয়তো না করে দিতেন। স্কুলে পড়ার সময় আম্মার একটাই শর্ত ছিল—যা-ই করি না কেন, সূর্য ডোবার আগে আগে বাসায় ফেরা চাই। মনে পড়ে, তখনকার সময়ে কেউ লন্ডনে গেলে বলতাম, আমার জন্য এক জোড়া রানিং স্পাইক ও এক জোড়া ফুটবল বুট নিয়ে এসো। ফুটবলে আমি এতটাই একাগ্র ছিলাম। ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে হরতাল ছিল অনেকটা কারফিউর মতো। তখন ধানমন্ডিতে আমার এলাকায় সারাদিন ফুটবল খেলতাম। স্কুলে যেতাম মাঝেমধ্যে রিকশায়, কখনো বাসে, কখনো হেঁটে। পড়তাম বিএএফ শাহীন স্কুলে। ধরাবাঁধা ছক কখনই আমাকে একটা গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখতে পারেনি। এরই ধারাবাহিকতায় সবে মেট্রিক পরীক্ষা শেষ। ওই বয়সেই ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবলে ওয়ারীর হয়ে অভিষেক, ১৯৬৯ সালে। অথচ এর আগের বছরই ক্রিকেটের প্রথম বিভাগে আমার শুরু! ছিলাম টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান। টানা তিন বছর স্কুল অ্যাথলেটিকসে পূর্ব পাকিস্তানের সেরা হয়েছি। পরে ফুটবলই হলো আমার জীবন। ফুটবল আমজনতার খেলা। ক্রিকেট একটু অভিজাত শ্রেণির। আমি যে পরিবার থেকে এসেছি, সেটি ছিল শিক্ষিত ও সচ্ছল। সেই হিসেবে ক্রিকেটেই জীবন গড়তে পারতাম অনায়াসে। তারপরও ফুটবলই বেছে নিয়েছি। ঢাকা লিগের সেই সোনালি দিনগুলো ভুলি কী করে! এক বছর ওয়ারীতে কাটানোর পর গেলাম মোহামেডান। তখন মোহামেডানে পাকিস্তান দলের আট-নয়জন খেলোয়াড়। একাদশে সুযোগ পাওয়া আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতোই ব্যাপার। আমাকে মাঠের বাইরে বসে থাকতে হয় কি না, সেই চিন্তায় অনেকেই বারণ করলেন মোহামেডানে যেতে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিতেই ভালোবাসি। একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের করাচিতে আমরা খেলতে গেলাম তত্কালীন পাকিস্তান জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। সেটি শেষ করার পরই পাকিস্তান দলে আমার ডাক এলো। কিন্তু আমি স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে ‘ফুটবলযুদ্ধে’ই নাম লিখলাম। স্বাধীন বাংলা দলটা ছিল পুরোপুরি সফল। এই দলটা পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে পায় দ্বিতীয় ম্যাচে মোহনবাগানের সঙ্গে খেলে। স্বাধীন বাংলা দল আমাকে দিয়েছে অভূতপূর্ব সব অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শুরু অন্য লড়াই। নিজেকে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়ার চূড়ান্ত পদক্ষেপ। দেশে ফেরার পর জাতীয় দলের অংশ হলাম। ১৯৭২ সালে প্রথম টুর্নামেন্ট স্বাধীনতা কাপে খেলেছিলাম মোহামেডানের জার্সি গায়ে। সেটা ছিল আমার জন্য সফল এক টুর্নামেন্ট। সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক, ফাইনালে দুই গোল। আমার ক্যারিয়ারে ওটা ছিল বিশাল এক বাঁক। তারপর আবার ঢাকায় মোহনবাগানের বিপক্ষে আমার গোলেই জয় পেল ঢাকা একাদশ। চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ল। টুর্নামেন্টটি খেলার পর শেখ কামাল একদিন এসে বলল, ‘তূর্য (আমার ডাকনাম), আমি আবাহনী নামে একটা দল করব। তুই কি আমার দলে খেলবি?’ কামাল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, স্কুল থেকে এই বন্ধুত্বের শুরু। কামালকে বললাম, ‘তোর কি মাথা খারাপ? আমি আবাহনীতে খেলব! মোহামেডান ছেড়ে কেউ নতুন দলে খেলতে যাবে!’ কামাল জেদ ধরল, আমাকে আবাহনীতে নেবেই। তখন মোহামেডানের বিরুদ্ধে দল গড়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছিল খুবই কঠিন। কামালকে বলেছিলাম, তুই যদি জাতীয় দলের মতো একটা গড়তে পারিস, তাহলেই তোর দলে খেলব। কামাল সে কাজটাই করল। আমি ওর দলে খেললাম। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে খেলতে গেলাম। সেখানে বসে শুনতে পাই, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে মেরে ফেলা হয়েছে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কামালের সম্মানে কখনো আবাহনী ছাড়ার কথা ভাবিনি। ১৯৮৪ সালে আবাহনীতে থেকেই অবসর নিই। আবাহনীতে থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সালে হংকংয়ে প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার হিসেবে পেশাদার লিগে অংশ নিই। ১৯৮৫ সালে আবাহনী থেকেই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। ফেডারেশন কাপ ছাড়াও আমার প্রশিক্ষণে আবাহনী লিগ চ্যাম্পিয়নও হলো। সেবারই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় সাফ গেমস। ফুটবলে জাতীয় দলেরও প্রশিক্ষক হয়ে গেলাম। দুর্ভাগ্য আমরা এগিয়ে থেকেও দেশকে সোনা উপহার দিতে পারিনি। ফাইনালে ভারতের কাছে টাইব্রেকারে হেরে যাই। ১৯৮৭ সালের দিকে কোচিং ছেড়ে পাঁচ বছর পর ১৯৯২ সালে আবার আবাহনীর কোচ হিসেবে ফেরা। ১৯৯২ সালে আবাহনীতে ফিরে আবার দলটাকে লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ উপহার দিলাম। ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব পালন করার পর আর কোনো দলকে প্রশিক্ষণ দিইনি। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে এলাম সহসভাপতি ও জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলাম। ফুটবল ফেডারেশনে যোগ দেব, সংগঠক হব তা কখনো ভাবিনি। আজ আমি দ্বিতীয় মেয়াদে দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচিত সভাপতি। ফিফার একটা সাব-কমিটিতে আছি। এএফসি-ফিফায় আমার যাতায়াত এখন নিয়মিতই। আপনাদের সবার দোয়ায় পথ চলেছি। আসলে ফুটবলে আমাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।



এই পাতার আরো খবর