ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

কোনো বড় দলেই গণতন্ত্র নেই
জুলকার নাইন
ড. নুরুল আমিন বেপারি

দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা নেই বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. নুরুল আমিন বেপারি। অবশ্য শুধু গণতান্ত্রিক চর্চাই নয় দলের মধ্যে আত্মসমালোচনারও যথেষ্ট অভাব আছে বলে মন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারির। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন।

ড. নুরুল আমিন বেপারি বলেন, রাজনৈতিক দলের বিকাশে পূর্বশর্ত হলো অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা। কিন্তু এ দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর একটির মধ্যেও ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। তার বড় প্রমাণ দলগুলোর কাউন্সিল। সাধারণত কাউন্সিল হলো দলের নতুন নেতৃত্ব বিকশিত করার একটি প্রক্রিয়া। এখানে ডেলিগেট বা কাউন্সিলররা নিজেদের প্রস্তাব, সুপারিশ উপস্থাপন করবেন। এসব প্রস্তাব সুপারিশের ওপর আলোচনা ও বিশ্লেষণ হবে। পরে সবার আলোচনা সাপেক্ষে নেতৃত্বের বিষয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ কাউন্সিলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই চর্চার মাধ্যমে দল হবে আরও শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সর্বশেষ গতকাল বিএনপির কাউন্সিলে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার লেশমাত্র দেখা গেল না। আগেই বিএনপি চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্ধারণ হয়ে গেল। সেখানে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীও পাওয়া গেল না। তা না করে কনফারেন্সে এ বিষয়ে প্রস্তাব চাওয়া যেত পারত। অবশ্য আগে থেকেই এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়ে থাকে যে, কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহসও পায় না। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিলেই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করে। আবার অন্য পদগুলোও একই রকমভাবে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সিদ্ধান্তেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। একই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণের দাবি করলেও আসলে তা হয় না। কারণ সবাই মিলে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী ঘোষণা করে বলে দেয়, আপনাকেই সব ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হলো— আপনিই বাকি সব পদ নির্ধারণ করে দেন। এটাই এখন আওয়ামী লীগের চিত্র। এটাকে কখনোই গণতান্ত্রিক চর্চা বলা যায় না। অথচ পাকিস্তান আমলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক বেশি গণতন্ত্র ছিল। তখন কনফারেন্সেই দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচিত হতো। তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদই এতদিন একক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। দলটি এমনভাবেই তৈরি যে, এরশাদের একক সিদ্ধান্তই সব। অন্য কারও কোনো স্থান এখানে নেই। তবে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর রওশন এরশাদ নিজে আলাদা করে কিছু ক্ষমতা নিয়ে নেন। তার সঙ্গে দলের সংসদ সদস্যরা চলে যান। কিন্তু এ সময়ও এরশাদের পক্ষ থেকে দলীয় বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার কোনোটিই গণতান্ত্রিক নয়। তিনি বলেন, শুধু গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবই নয়, দলগুলোর ভিতরে আত্মসমালোচনারও কোনো স্থান নেই। নেতারা তাদের বা দলের ভুলের কোনো সমালোচনা করেন না, শুধু স্তুতি ও প্রশংসাই ঝরে পড়ে নেতাদের বক্তব্যে। এভাবে কোনো দলের রাজনৈতিক বিকাশ কখনোই সম্ভব নয়। বরং কর্তৃত্ববাদিতার চর্চা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারির মতে, গণতন্ত্র কখনো হঠাৎ করে আসে না। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। বাড়িতে-পরিবারে গণতন্ত্র চর্চা প্রয়োজন। এরপর আসে সমাজ, দল ও জাতীয় জীবনে গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়। এ ছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গণতান্ত্রিক অর্থনীতির অনুপস্থিতি। কারণ বর্তমান সময়ের গণতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিপতি বুর্জোয়াদের গণতন্ত্র। পুঁজিবাদের বিকাশ হলেই এই গণতন্ত্রের বিকাশ হয় এবং শক্তিশালী হয়। যেমন প্রতিবেশী ভারতের বেশ বড় বড় কিছু পুঁজিপতি গড়ে ওঠায়, তারা তাদের নিজেদের পুঁজির সুরক্ষার স্বার্থেই তাদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে শক্তিশালী করেছেন। তিনি বলেন, ভারতে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসই ক্ষমতা ছিল। তখন হঠাৎ করে গরিবি হঠাও আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন পুঁজিবাদি অন্যান্য বিশ্ব মোড়লরা ভারত যেন সমাজতন্ত্রের দিকে না যেতে পারে সে জন্য সজাগ হয়ে ওঠে। ফলে কংগ্রেসের পতন ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি আসে ক্ষমতায়। আবার সর্বশেষ নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পিছনেও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাই মুখ্য। অন্যপক্ষে বাংলাদেশের পুজিপতিরা লুটেরা। এই লুটেরা পুঁজিপতিরা শিল্পের বিকাশের চেয়ে ব্যাংক লুট বা রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতেই বেশি উৎসাহী। ফলে গণতান্ত্রিক অর্থনীতি তৈরিতে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর ব্যক্তি স্বাধীনতা হলো প্রকৃত গণতন্ত্র। বাংলাদেশ সেদিক থেকে দিনে দিনে দূরে সরে যাচ্ছে।



এই পাতার আরো খবর