ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অংশ নিই মুক্তিযুদ্ধে
এইচ টি ইমাম

১৯৭১ সালের ১ মার্চ সচিবালয়ে কাজ সেরে আমার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ (তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ) যাওয়ার কথা। দুপুর ১২টা থেকে ১টার দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রেডিওতে ভাষণ দেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা যে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাঞ্জাবি শাসকদের ষড়যন্ত্র— তা পূর্ব বাংলার জনগণ সহজেই বুঝতে পারল। পূর্ব বাংলার সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠল। ঢাকার মতিঝিলে পূর্বাণী হোটেলের সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংক্ষিপ্ত ভাষণে ইয়াহিয়ার কঠোর সমালোচনা করেন। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম শিগগিরই রাঙামাটি ফিরে যাব। কারণ বঙ্গবন্ধু দেশকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন যে বাজি রেখেছেন আমরা সবাই অনুধাবন করছিলাম। সেই উপলব্ধি থেকেই আমরা প্রতিজ্ঞা করি, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে আমাদেরও অবদান রাখতে হবে। মার্চে ধাপে ধাপে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে আমরা সক্রিয় হয়ে উঠি। মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সহযোগিতা করি। 

২ মার্চের পর ঘটনাবলি অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে চলে, সেই সঙ্গে প্রেক্ষাপটও পরিবর্তিত হয়। ৩ মার্চ চট্টগ্রামে যে ঘটনা ঘটে পরবর্তীকালের ঘটনার মধ্যে তা হয়তো অনেকটা চাপা পড়ে যায়। ৩ মার্চ দুপুরের দিকে খবর পেলাম চট্টগ্রামে প্রচণ্ড গোলযোগ হচ্ছে। ২ মার্চ বিকালে জনসভার পর অনেক মিছিল বের হয়। এসব মিছিলের ওপর বিহারিরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হামলা চালায়। শেরশাহ কলোনি, ফিরোজ শাহ কলোনি, পাহাড়তলী প্রভৃতি স্থানে হামলা চলে। লালদীঘি ময়দানে আগমনরত এবং প্রত্যাবর্তনের পর মিছিলের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালানো হয়।  এতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়, সেনাবাহিনী এবং অবাঙালিরা আগে থেকেই তৈরি ছিল এবং বাঙালিদের প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি তারা নিয়েছিল। রাঙামাটি সদরের এসডিও আবদুল আলী ছিলেন আরেক মহত্প্রাণ, বাংলাদেশের জন্য নিবেদিত। আবদুল আলী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। 

এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনারা রাঙামাটি দখলের সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে। সে সময় তিনি রামগড়ের পথে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা অমানুষিক অত্যাচার করে আলীর ওপর, আমার গতিবিধি এবং কার্যকলাপ জানার জন্য। শহীদ আবদুল আলী নিজে প্রাণ দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষা করেছেন। তিনি শত অত্যাচারেও মুখ খোলেননি কিংবা আমাদের গতিবিধি ও কাজ সম্বন্ধে শত্রুদের কাছে কিছু ফাঁস করেননি। এস এ সামাদ এবং এম ই শরীফ রাঙামাটিতে আমাদের সঙ্গে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে পড়েন সমগ্র পার্বত্য এলাকায় ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীকে মানসিক প্রস্তুতি ও সংগঠিত করতে। তাদের দায়িত্ব ছিল জেলার বিভিন্ন থানা, বড় বড় হাটবাজার পুলিশ ক্যাম্পে জোয়ানদের সঙ্গে কথা বলা এবং তাদের আসন্ন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণিত করা। সামাদ আর শরীফের চমৎকার সচলতা ও যোজনার ফল আমরা ২৫/২৬ মার্চে হাতে হাতে পাই। ৭ মার্চের পর বিভিন্ন সময় ঢাকা থেকে আমাদের কাছে বুলেটিন আসতে শুরু করল। জাতীয় পতাকার নমুনা, জাতীয় সংগীত, স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি সম্বন্ধে আমরা অবহিত হতে থাকলাম। 

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পর রাঙামাটিতে সবকিছু বুঝে গোছাতে আমাদের কয়েকদিন সময় লেগেছিল। ১০-১১ তারিখের দিকে ছাত্রমহল থেকে সঠিক সংবাদ পাওয়া শুরু করলাম। ঢাকার সঙ্গে ছাত্রদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল, সে সুবিধা আমাদের ছিল না। তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেসব নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল তাই দেশবাসী পালন করছিল। পুলিশ বলতে গেলে একরকম নিষ্ক্রিয়। ১০ মার্চ থেকে ১৭ মার্চ মোটামুটি এভাবে কাটল। এর মধ্যে এমন কিছু খবর এলো যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। 

১৭ মার্চ সকালে হাজির হলাম ডিসি মুস্তাফিজুর রহমানের বাংলোয়। সেখানে বসে আছে সহকর্মী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ঢাকা থেকে তাকে ব্যক্তিগত বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছে তৎকালীন সিএসপি সমিতি পূর্ব পাকিস্তান শাখা। ২৬ মার্চ সকালের মধ্যে আমাদের বার্তা পেয়ে রাঙামাটি থেকে পাঠানো লঞ্চে করে দলে দলে ইপিআর ও পুলিশের জোয়ানরা সুদূর বরকল, দীঘিনালা, মারিশ্যা, মহালছড়ি এসব জায়গা থেকে জমায়েত হলো কোর্ট প্রাঙ্গণে। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা, খাওয়া আর ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা। বাংলাদেশ এগিয়ে চলল চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পথে।

বিডি-প্রতিদিন/ ২১ মার্চ, ২০১৬/ রশিদা



এই পাতার আরো খবর