ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

প্র তি ক্রি য়া
তনু আমার কন্যা আমার বোন
ফরিদা ইয়াসমিন
তনু আমার কন্যা, তনু আমার বোন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের স্নাতকের ছাত্রী ছিল সোহাগী জাহান তনু। কুমিল্লা সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত এলাকায় ধর্ষণ এবং খুন হয় তনু। তনুর বয়স ১৯। তনুর কথা ভাবলে আমার ১৯ বছরের কন্যাটির কথা মনে হয়। সে সুদূর আমেরিকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ছে। আমেরিকা থেকে ফোন করে মেয়ে বলল, মা এমন বর্বর অমানবিক ঘটনার শিকার আমিও হতে পারতাম। আমি যখন দেশে ছিলাম, রিকশা করে কোথাও যেতাম, তখন আমার খুব ভয় করত। এখানে অন্তত এমন ভয় নেই। আমার ছোটবোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে এখন কানাডায়। তনুর ঘটনায় তার মধ্যেও প্রতিক্রিয়া হয়। আমাকে ফোন করে বলে, বড়দি, আমার সঙ্গেও এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে পারত। দেশে আমি প্রায়ই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। এখানে অন্তত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি না। বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে নিজের শরীর নিয়ে একটা ভয় ও আতঙ্কে বেড়ে ওঠে। বেশির ভাগ মেয়েই শৈশবে যৌন নির্যাতনের মতো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বড় হয়। রাস্তাঘাটে, কখনো আত্মীয়স্বজনের দ্বারাও যৌন নির্যাতনের সম্মুখীন হয়। যৌন হয়রানি তাদের জীবনে সংশয় ডেকে আনে। বিয়ের প্রস্তাবে, কখনো কুপ্রস্তাবে রাজি না হলে এসিড নিক্ষেপ বা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে, নারীর একা চলাফেরা নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলে নারীর ওপর মানুষরূপী হায়েনা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামে এক নারী চিকিৎসককে সিএনজি চালক নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। তবে ওই চিকিৎসকের চিত্কারে লোকজন ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে আর চালককে পুলিশে সোপর্দ করে। এটা খুবই দুঃখজনক যে, আমাদের সমাজে যখন একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়, উল্টো তাকে দায়ী করা হয়। তার চালচলন ভালো ছিল না, তার পোশাক-আশাক ভালো ছিল না ইত্যাদি। কিন্তু যে তনু ধর্ষণের শিকার হয়ে খুন হলো সে তো হিজাব পরত। তার পোশাক-আশাক তো অশালীন ছিল না। তনু কি পেরেছে ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচতে? শুধু ধর্ষণ নয়, তনুকে খুন করা হয়েছে। তনু হয়তো ধর্ষণকারীকে চিনে ফেলেছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের ঘটনার প্রমাণ যাতে না থাকে, ভিকটিম খুন হয়। সবচেয়ে বড় কথা ক্যান্টনমেন্টের মতো একটি নিরাপত্তা বেষ্টনী এলাকায় কীভাবে তনু নারী জীবনে সম্ভ্রম হারায়, লাশ হয়? তাহলে নারী কোথায় নিজেকে নিরাপদ ভাববে? আমরা জানতে চাই কী ঘটেছে ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তুবার ক্ষেত্রে। কয়েক দিন আগে কলেজের বাথরুমে তুবার মৃতদেহ পাওয়া যায়। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, সে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু তার আত্মীয়স্বজনের ধারণা তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল এবং তার নখে রক্ত জমাটবাঁধা অবস্থায় ছিল। দেশবাসী এ ঘটনার প্রকৃত তথ্য জানতে চায়। আমাদের সমাজে ধর্ষণের যে মধ্যযুগীয় অসভ্য সংস্কৃতি দিন দিন ভয়াবহ হারে বাড়ছে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? আমি সংস্কৃতিই বলব, ধর্ষণের সংস্কৃতি। কারণ এ ধর্ষণ আগেও ছিল, এখনো আছে। আর আমরা আমাদের সমাজে তা লালন করছি। পরিবার সমাজে এ ধরনের অনেক ঘটনা চেপে যেতে বলা হয়। এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীরা পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায়, তাদের কিছু হয় না। আইনে ধর্ষণের শাস্তি আছে যাবজ্জীবন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডও। কিন্তু তার প্রয়োগ হয় না। খুব কমক্ষেত্রেই ধর্ষণের শাস্তি হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ শফী প্রকাশ্যে জনসভায় নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করেন। বলেন, নারীকে দেখলে পুরুষের লোভ হবে এবং লালসা চরিতার্থ করতেই পারে। আল্লামা শফীর মতো ইসলামী চিন্তাবিদ (?) যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তা ধর্ষণের মতো অসভ্যতাকেই উসকে দেওয়া হয়। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন এ ধরনের বক্তব্যের জন্য কোনো বিচার হয় না, তাতে এ ধরনের বক্তব্যকে উৎসাহিত করা হয়। সমাজে যাদের মতমোড়ল বা অপিনিয়ন লিডার বলে ধরে নেওয়া হয় যেমন— মসজিদের ইমাম বা গাঁয়ের মোড়ল যখন বলেন, নারীকে পর্দা-পুশিদায় থাকতে হবে, না হলে পুরুষের কামনা জেগে উঠলে যে কোনো অঘটন ঘটতে পারে, এতে নারীরই দোষ। এভাবে অনেক ইমাম বা ধর্মীয় নেতা ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, তাতে সমাজে ধর্ষণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে জায়েজ তাই বোঝানো হয়। বিশেষ করে অনেক পুরুষ মনে করে ধর্ষণের মতো অপরাধ তেমন কোনো অপরাধ নয়। পশ্চিমবঙ্গের খুব জনপ্রিয় এক চিত্রনায়ক এবং এমপি বলেছিলেন, ধর্ষণ নিয়ে এত হৈচৈ করার কী আছে। ধর্ষণের সময়টাতে মেয়েটি তা ‘এনজয়’ করলেই পারে। পরে নারী আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে তাকে সেই বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হয়। পুরুষ আধিপত্যের এই সমাজে ধর্ষণকে খুব একটা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। বাংলাদেশে অনেক গ্যাং র‌্যাপের ঘটনা ঘটলেও তার বিচার হয় না। প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে ধরে নেয় মেয়েটার কোনো দোষ ছিল, তাই এ ঘটনা ঘটছে। কখনো কখনো পুলিশ মামলা নিতে চায় না, মামলা নেওয়ার আগে প্রমাণ চায়। প্রমাণ করাটা কঠিন। এর জন্য যে মেডিকেল পরীক্ষা করতে হয় এটা মেয়েটার জন্য এবং পরিবারের জন্য বিব্রতকর। সিলেট অঞ্চলের এক মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ শহীদুল ইশান ব্রিটিশ এক সংবাদ মাধ্যমে ভিডিও সাক্ষাত্কারে ধর্ষণ সম্পর্কে বলেন, মহিলাদের যদি পুরুষ না পায় তাহলে তো ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে না। মহিলা রাতে একা বেরুলে পুরুষ তাকে দেখলে আর নিজেকে ‘সভ্য’ রাখতে পারে না। তাই মহিলাদের পর্দা এবং চার দেয়ালে বন্দী থাকতে হবে। একই সাক্ষাত্কারে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পর্দা করলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। পর্দা না করলে একজন পুরুষ তো আকৃষ্ট হবেই। তাদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, এ ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী নারী। জনগণের পয়সায় যে প্রশাসন চলে তারা সভ্য সমাজের মানুষের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বিশেষ শ্রেণির মানুষ নামের পশুদের পক্ষে দাঁড়ায় তা অবশ্যই অপরাধ। আর এ ধরনের বক্তব্য সমাজে বিষবাষ্প ছড়ায়। এ ধরনের বক্তব্যের জন্য তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু কখনো সমাজবিরোধী, নারীবিরোধী এ ধরনের বক্তব্যের জন্য কারও শাস্তি হতে শুনিনি। মূল্যবোধ গড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকে, পরিবার থেকে। শিক্ষাটা পরিবার থেকে আসে। সচেতনতাটা পরিবার থেকেও শুরু হয়। পাশাপাশি এসব ঘটনার ক্ষেত্রে সমাজকে সচেতন এবং প্রতিবাদী হতে হবে। হতে হবে সামাজিক আন্দোলন। তনুর ধর্ষণ ও হত্যা যেন সমাজকে জাগিয়ে তোলে। যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে কুমিল্লা থেকে, তা ছড়িয়ে পড়ুক দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ আগুন হয়ে জ্বলে উঠুক দেশের প্রতিটি গ্রাম, গঞ্জ, শহরে। মানুষের চেতনা জাগ্রত হোক। ধর্ষণ কোনো পৌরুষের বিষয় নয়, এটা ভয়ানক একটি অপরাধ— এই বোধ জাগ্রত হোক প্রতিটি মানুষের মনে। জেগে উঠুক রাষ্ট্র। তনু হত্যার এমন শাস্তি দিক, যা এ দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। নারীর স্বাধীন চলাচলবিরোধী বক্তব্য নারীর বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধেরই শামিল— রাষ্ট্র এ বিষয়টিও আমলে নিক। পুরুষ আধিপত্যের এই সমাজ হয়ে উঠুক নারী-পুরুষ সবার।   লেখক : সাংবাদিক


এই পাতার আরো খবর