ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

বিদায়ী গভর্নরকে সাধুবাদ
খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ

২০১০ সালে শেরপুর জেলার কাকরকান্দি গ্রামে কৃষি ব্যাংকের একটি শাখা উদ্বোধন করেছিলেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সঙ্গে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সোহাগপুর নামে একটি গ্রাম রয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে গ্রামটি বিধবাপল্লী নামে পরিচিত। একাত্তরের ২৫ জুলাই পাকহানাদার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে এ গ্রামে নিয়ে আসে রাজাকাররা।  গ্রামবাসী যার যার কাজে ব্যস্ত। কেউ ক্ষেত নিড়ানি দিচ্ছেন। কেউ শাকসবজি তুলছেন। কেউ বাজারে যাচ্ছেন। কেউবা মেঠোপথে হেঁটে চলেছেন। হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকেই আচমকা গুলি চালাতে লাগল। পুরুষ মানুষ দেখামাত্র গুলি। যে যেখানে ছিল সেখানেই তার মৃত্যু ঘটল। ঘরের ভিতর ঢুকেও পুরুষ মানুষদের হত্যা করা হলো। শুনলাম, গ্রামের সব সক্ষম পুরুষ মানুষ হত্যা করে রাজাকার আর হানাদাররা ফিরে গেল। বেঁচে রইল শুধু বিধবারা। আর বেঁচে রইল শিশু ও বৃদ্ধ। সোহাগপুর গ্রামে সোহাগ করার কেউ রইল না। সেই থেকে গ্রামটির পরিচিতি বিধবাপল্লী নামে। বিহ্বল হৃদয়ে হাজির হলাম বিধবাপল্লীতে। সেখানেও একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। প্রধান অতিথি বেগম মতিয়া চৌধুরী। সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন ট্রাস্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিধবাদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠান। জীবিত বিধবারা আজীবন অর্থ সাহায্য পাবেন। যেসব বিধবা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারবর্গ পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত অর্থ-সহায়তা পাবেন। অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে ‘বিধবা পল্লীর বোবা কান্না’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। নিবন্ধটির সহায়তায় কিছু কথা স্মরণ করছি।

অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। শহীদ স্মরণে সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ব্যথিত হৃদয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। তারপর ফিরে এলেন তাঁবুর নিচে। বেগম মতিয়া চৌধুরী তখনো আসেননি। পরিচয় পেয়ে বয়সের ভারে নুব্জ বিধবারা গভর্নরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। গভর্নর তাদের কাছে বসালেন। সাংবাদিকদের সরিয়ে দিয়ে ড. আতিউর বিধবাদের সঙ্গে কুশলবিনিময় শুরু করলেন। অশ্রুসিক্ত বিধবারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেন। তখন ড. আতিউর এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ৪০ বছর কেমন ছিলেন?’ এ যেন বেদনার বেলুনটাকে ঘা দিয়ে ফুটিয়ে দেওয়া। বৃদ্ধার চোখে শ্রাবণের ধারা। বাকরুদ্ধ। মাঝেমধ্যে বিশম খাওয়ার মতো কি কথা যেন বুক থেকে কণ্ঠনালি পর্যন্ত এসে স্বরকম্প সৃষ্টি করছে। কথা বেরুচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধা যা বললেন তার সারমর্ম হলো— ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের কষ্ট বর্ণনাতীত। পাকসেনারা পুরুষ নিধন করে চলে গেছে। বৃদ্ধ ও শিশুদের দেখভাল করেছে বিধবারা। ভয়ে কেউ এ গ্রামে আসত না। কেউ সাহায্য করতেও সাহস পেত না। খোঁজও নিত না। না খেয়ে থাকতাম। দুই-তিন দিন পর পর রাতে দূর থেকে একজন গারো আদিবাসী এসে কিছু খাবার দিয়ে যেতেন। সেদিন ভাগ করে খেতাম। দিন কাটত যেমন তেমন। রাত হলেই ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতাম। ড. আতিউর সহানুভূতির সঙ্গে দু-একটি কথা বলে পরিবেশটা স্বাভাবিক করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ নগদ সাত হাজার টাকা পাবেন। এরপর প্রতি মাসে পাবেন এক হাজার টাকা। শুনে কেমন লাগছে?’ বৃদ্ধার চোখে এবারও অশ্রু। আনন্দাশ্রু। ঠোঁটে দ্বিতীয়া চাঁদের হাসি। মুখে বললেন, ‘আমার জন্যে অনেক। ভালো থাকবো। খুব খুশি।’ অন্য একজন মহিলাকে ড. আতিউর জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিয়ের কত বছর পর বিধবা হয়েছেন?’ মহিলা জবাব দিলেন, ‘বিয়ের মাত্র ছয় মাস পর ক্ষেতে চাষ করার সময় পাকসেনা বিনা কারণে গুলি করে মেরে ফেলেছিল।’ মনে মনে ভাবছিলাম, সবুজ ধানক্ষেতে লাল রক্ত ছড়িয়ে যেন জয় বাংলার লাল-সবুজ পতাকা আন্দোলিত হয়েছিল। ড. আতিউর একে একে অনেক বিধবার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে খোঁজ নিলেন। তারপর উপস্থিত ব্যাংকারদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন গ্রামে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন এবং জীবিত ও মৃত একাত্তরের প্রত্যেক বিধবার পরিবারের সদস্যদের স্বাবলম্বী হতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করেন। প্রয়োজনে হতদরিদ্র পরিবারের জন্য সিএসআর ফান্ড থেকে যেন সাহায্য করা হয়।

ড. আতিউর গভর্নর পদে যোগদানের পর কিছু কাজ করেছিলেন, যা ইতিপূর্বে কোনো গভর্নরই করেননি। কারণ এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাজ নয়। কৃষি ব্যাংক আগে থেকেই গ্রামে কৃষক সমাবেশের আয়োজন করে আসছিল। গভর্নর ওইসব সমাবেশে যোগদান করে নিজ হাতে কৃষিঋণ বিতরণ শুরু করলেন। একটি নয়, দুটি নয়, অনেক কৃষক সমাবেশে তিনি গিয়েছিলেন এবং সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে একাকী কথা বলে অনিয়ম দুর্নীতি জানার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এতে করে একটি সুফল পাওয়া গেল। কৃষিঋণ কর্মকর্তার ঋণের টাকায় ভাগ বসানোর যে অভিযোগ দীর্ঘদিন থেকেই শোনা যেত, তা যেন সহসাই অতীত ইতিহাস পরিণত হলো। কৃষি ব্যাংক ঋণ গ্রহীতাদের তালিকা প্রকাশ্য স্থানে টানিয়ে রাখত, যাতে ভুয়া ঋণগ্রহীতা চিহ্নিত হতে পারে। ড. আতিউরের অপ্রত্যাশিত পরিশ্রমের ফলে কৃষিঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা ফিরে এলো। ঋণপ্রবাহও বৃদ্ধি পেল। পূর্বের চার-পাঁচ হাজার কোটি থেকে এখন কৃষিঋণ দাঁড়িয়েছে ষোল হাজার কোটি টাকার অধিক।

ড. আতিউর নারী উদ্যোক্তা তথা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও উৎসাহিত করেছিলেন। ঢাকার বড় বড় নামিদামি দোকানে মফস্বলের যেসব নারী উদ্যোক্তা নকশি কাঁথাসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্রী সরবরাহ করত, ড. আতিউর তাদের কর্মস্থলে গিয়ে হাজির হতেন। সঙ্গে নিয়ে যেতেন ব্যাংকারদের। তাত্ক্ষণিক নির্দেশনায় ঋণ বিতরণের ব্যবস্থাও হয়ে যেত। এভাবে মফস্বলে বেশ কিছু হস্তশিল্প পল্লী গড়ে উঠেছিল এবং প্রসার লাভ করেছিল। ক্ষীণকণ্ঠের ওইসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ড. আতিউরের পদত্যাগে ব্যথিত হবে, যদিও সোচ্চার হওয়ার সুযোগ তাদের নেই।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি টকশোতে সঞ্চালক হিসেবে আমি ড. আতিউরকে ওই সময় প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এমন সব অগভর্নরসুলভ কার্যক্রমে কেন তিনি ব্যস্ত থাকছেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ (পড়ত্ব ভঁহপঃরড়হ) সূচারুভাবে করার পর দরিদ্রজনের জন্য যদি আমি অতিরিক্ত পরিশ্রম করি, তাতে দোষ কি?’ সেদিনের এ কথাটি আজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ হলো সফল মুদ্রানীতির দ্বারা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। ড. আতিউর অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রকাশ্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতেন, যেমনটা আগে হতো না। ফলে মুদ্রাস্ফীতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণেই থাকত। সাম্প্রতিককালে মুদ্রাস্ফীতি নিম্নমুখী হয়েছে। কাজেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ তিনি দক্ষতা এবং সফলতার সঙ্গেই সম্পাদন করেছেন। সেই সঙ্গে কৃষিঋণ, ক্ষুদ্রঋণ প্রবাহ বহুগুণ বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি যে অন্তর্ভুক্তিমূলক (রহপষঁংরাব) অর্থনীতির প্রবর্তন করেছিলেন, তদ্বারা বিদেশে তিনি ব্যাপক সমাদৃত হয়েছেন। তাকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ গভর্নর আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি ‘গ্রিন গভর্নর’ নামে সমাদৃত হয়েছেন।

লুটপাট ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে ‘মুক্তবাজারের’ নামে দেশে প্রকৃতপক্ষে যে ধনবাদী অর্থনীতি জেঁকে বসেছে, এর ফলে দেশে আয় তথা সম্পদ বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার পর বৈষম্য মাপক গিনি সহগ ছিল পয়েন্ট দুই-চার, যা সহনীয় বলে গণ্য। আজ তা দাঁড়িয়েছে পয়েন্ট চার-ছয়, যা চরম বৈষম্য নির্দেশ করে। এমন পরিস্থিতিতে ড. আতিউরের অন্তর্ভুক্তিমূলক (রহপষঁংরাব) অর্থনীতির কার্যক্রম প্রবর্তন ও সম্প্রসারণ বৈষম্য হ্রাসে অল্প হলেও অবদান রেখেছে। গিনি কোয়েফিশিয়েন্ট বর্তমানে আর বাড়ছে না। বঙ্গবন্ধুর কল্যাণ অর্থনীতি তথা মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতিতে প্রত্যাবর্তনের দুঃসাহসিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ড. আতিউরকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। হয়তো এ কারণেই প্রতিক্রিয়াশীলদের অপরাজনীতির শিকার হয়েছেন তিনি।

সবশেষ সংবাদে প্রকাশ, ফিলিপাইনে রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের সুবিধাভোগীরা দোষ স্বীকার করেছে এবং কিছু অর্থ এখনই বাংলাদেশকে ফেরত প্রদানের প্রস্তাব করেছে। শ্রীলঙ্কা থেকে ২০০ কোটি টাকা আগেই ফেরত এসেছে। ফেড রিজার্ভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ব্যাংকেরও গাফিলতির অভিযোগ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনি পরামর্শক ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন। এসব তো ড. আতিউরের গোপন অথচ সঠিক দৃঢ় পদক্ষেপেরই সুফল। গভর্নর তাত্ক্ষণিকভাবে সরকারকে গোপনে তথ্যটি জানালে তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর বা ভাগ করে নিতে পারতেন। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় কি অর্থবহ কিছুই করতে পারত? অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক আর বেসিক ব্যাংকের কারচুপি প্রথম থেকে প্রতিনিয়ত অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।  অর্থ মন্ত্রণালয় আট হাজার কোটি টাকার এক পয়সাও আদায় করতে পারেনি। উপরন্তু জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে অনৈতিকভাবে ওইসব ব্যাংকের ঘাটতি পূরণ করেছে।

চেয়ারম্যানকে অপসারণ পর্যন্ত করেনি। এর বিপরীতে ৮০০ কোটি টাকা হ্যাকিং এরপর রাজনীতির মারপ্যাঁচে গভর্নরকে পদত্যাগে প্ররোচিত করা হলো। দুজন ডেপুটি গভর্নরকে তদন্তের আগেই অপসারণ করা হলো। অর্থমন্ত্রী তদন্তের আগেই বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করে বেফাঁস (ঢ়ত্ব-বসঢ়ঃরাব) বক্তব্য রাখলেন, যা বাংলাদেশের দাবিকে দুর্বল করে দেবে।  নিজ ঘাড়ে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করার জন্য ড. আতিউর রহমানকে সাধুবাদ। কিন্তু বিনা কারণে তাকে এবং তার দুই সহকর্মীকে যে হেনস্থা করা হলো, অপদস্থ করা হলো এবং চায়ের কাপে অপরাজনীতির ঝড় তুলে জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা হলো,  এর দায়-দায়িত্ব কার?

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর।



এই পাতার আরো খবর