ঢাকা, বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

লেখকের অন্য চোখ
সেই প্রথম কোনো মহিলা আমাকে ডেকেছিলেন
সমরেশ মজুমদার

মানিকতলার মোড়ে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে হয় বলে রামমোহন লাইব্রেরির উল্টোদিকে সুকিয়া স্ট্রিটে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছিল ড্রাইভার। তার ইচ্ছে সোজা কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে শ্যামবাজারে যাবে।

 বহুকাল ওই পথে যাইনি। সন্ধ্যে সবে পার হয়েছে, ঝমঝমিয়ে অনেক কথা মাথায় এসে যাওয়ায় ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকালাম। ওই পাড়াতেই কলকাতায় পড়তে এসে একটা বছর ছিলাম। ওই যে ডানদিকের রাস্তা যার নাম আশুতোষ শীল লেন, সেটা ধরে খানিকটা গেলেই রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে পা দিতে হবে। ঠিক সেই মোড়ের ডানদিকে ছিল আমাদের হোস্টেল টমোরি মেমোরিয়াল হোস্টেল। স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রদের থাকার হোস্টেল। নিশ্চয়ই টমোরি নামের কোনো সাহেবের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে নামকরণ করা হয়েছিল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে তার বাঁ-দিকের রাস্তাটার নাম বিদ্যাসাগর স্ট্রিট। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বাড়ি। হোস্টেলের দ্বিতীয় দিনে সেই বাড়ি দেখতে গিয়ে পুলকিত হয়েছিলাম। তখন আমার সতেরো বছর বয়স। চারপাশে তাকালাম। মোটামুটি একই চেহারায় রয়েছে পাড়াটা। আশুতোষ শীল লেনের মুখের বাড়িতে কাজলদি থাকতেন। স্কটিশে আমাদের চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র। মুখটা মনে এলো। ফর্সা, বড় চোখ। আলাপ হওয়ার পরেই বলেছিলেন, ‘তুই আমাদের পাড়ায় উঠেছিস? রোববারের সকালে চলে আসবি, জলখাবার খেয়ে যাবি। হোক বয়সে বড়, সেই প্রথম কোনো মহিলা  আমাকে তার বাড়িতে ডেকেছিলেন। কাজলদির খবর জানি। ওই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন বিয়ের পরে। বাড়িটার দিকে তাকাতেই কাজলদির হাসি মনে চলে এলো। আশুতোষ শীল লেনে ঢুকলাম। এই গলির প্রায় সব বাড়ির মানুষদের ওই এক বছরে চিনে ফেলেছিলাম। আশ্চর্য, এখন কারও নাম মনে পড়ছে না। বাঁ-দিকে একটি প্রতিবন্ধী ছেলে থাকত। হাঁটতে অসুবিধে হলেও সে তোয়াক্কা করত না। আমার চেয়ে বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও দেখা হলেই বকর বকর করত। কী যেন নাম? আঃ! আর একটু এগোতেই বীরদের বাড়িটা দেখলাম। এই নামটা তো ভুলিনি, বাড়িটাকে দেখেই মনে এলো। বীর এবং ওর বোন কেয়া। প্রায়ই এই বাড়িতে আসতাম। বীরের মা যখন-যা পেরেছেন খেতে দিতেন। বীর কেয়াকে নিয়ে আমার হোস্টেলেও যেত। হোস্টেলে মেয়েদের ঢোকা নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ছয় বছরের কেয়াকে কেউ বাধা দিত না। দরজা খোলা। প্যাসেজের শেষে আর একটা দরজা, যার ফাঁক দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে। প্রথম দরজায় কড়া নাড়লাম। তিনবারেও ভিতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। বীরের এক দাদার ব্যবসা ছিল সার্কুলার রোডে। কী যেন নাম? মনে পড়ল না। আমি পাশের জানলায় গেলাম। সেখানে মধ্য তিরিশের একজন বসে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বীররা নেই বাড়িতে?’

‘কে বীর?’ ভদ্রলোক অবাক হলেন।

‘আপনার পাশের বাড়িতে থাকে। বীর, কেয়া।’

‘কাদের কথা বলছেন জানি না। আমরা বছর বারো এখানে আছি। আপনি এখানে শেষ কবে এসেছেন?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি বছর গুনলাম। বললাম, ‘তেপ্পান্ন বছর আগে।’

‘তাই বলুন! এতদিন কেউ থাকে!’

‘তার মানে?’

‘এখন মনে হচ্ছে আপনি যাদের খোঁজ করছেন তারা অনেক আগে এই বাড়িতে থাকতেন। একটু দাঁড়ান, আমাদের এখানে যে কাজ করে সে বহুকাল পাড়ায় আছে, তাকে জিজ্ঞাসা করে আসছি।’ ভদ্রলোক ভিতরে চলে গেলেন।

আমরা কথা বলছিলাম জানলার দু’পাশে দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক কী বললেন? এতদিন কেউ থাকে! বীর আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট ছিল। পঁয়ষট্টি বছরের কোটি কোটি মানুষ পৃথিবীতে কাজ করে যাচ্ছে।

ভদ্রলোক ফিরে এলেন, ‘সরি। বীরের মৃত্যু আগে হয়েছিল। ওর মা তার পরে। বোনেদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কে কোথায় জানা যাচ্ছে না। ওরা আপনার কেউ হয়?’

আমি অসার হয়ে গেলাম। কোনোমতে মাথা নাড়লাম, যার মানে, হয়। সরে এসে বাড়িটার দিকে তাকালাম। এই বাড়িতে একসময় যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল আমার। বীরের মা প্রায় আমার মায়ের ভূমিকা নিয়েছিলেন। গেলেই কিছু না কিছু খেতে দিতেন। এখন বাড়িটা আছে, ওরা কেউ নেই, পৃথিবীর অনেক অদল-বদল হয়েছে। যদিও আমার মনে ওরা এতকাল একই জায়গায় ছিলেন। আমারও যে বয়স বেড়েছে, শরীরের পরিবর্তন হয়েছে, তেমন করে অনুভব করিনি কখনো। বহুকাল ধরে আমি একই জীবনযাপন করে চলেছি। আমার মনের বয়স বাড়তে এখন এই মুহূর্তে একটুও কষ্ট পেল না।

মোড়ের মাথায় এসে চমকে উঠলাম। আমাদের হোস্টেলের জায়গায় একটা বহুতল বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একই কলকাতায় থেকেও জানতাম না হোস্টেলটা আর নেই। হোস্টেলের উল্টো দিকের বাড়িতে অরূপদারা থাকত। কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি। ওর মৃত্যুর খবর আমি জানি। শুনলাম বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। পাশের বাড়িটা এখন আগের থেকে ঝকঝকে। ওই বাড়ির মেয়ের নাম ছিল অরুনা। তাকে বিরক্ত করার জন্য আমাদের হোস্টেলের ছেলে আশিস খুব ধমক খেয়েছিল সুপারের কাছে। সেই আশিস এখন কোথায় জানি না। মনে হচ্ছিল আমি একটা শ্মশানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। ওই যে জলের কলের বাড়িটা, ওখানেও খুব রাগী এক ভদ্রলোক থাকতেন। রাস্তা দিয়ে আমাদের যেতে দেখলেই মেয়েকে গম্ভীর গলায় বলতেন, ‘জানলা থেকে সরে এসো।’ ভদ্রলোকের এখন আর থাকার কথা নয়। ইতস্তত পায়ে ওই বাড়ির সামনে পৌঁছতেই দেখলাম একজন প্রৌঢ়া জানলার ওপাশে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছেন। মাথা ভর্তি পাকা চুল। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু মনে করবেন না, এই বাড়িতে চন্দনা আর ওর বাবা থাকতেন। তারা কি আছেন?’

প্রৌঢ়ার মুখে বিস্ময় স্পষ্ট হলো। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’

‘আমি ওই হোস্টেলে থাকতাম।’

‘বাবা নেই। অনেক বছর হয়ে গেল। আমি চন্দনা। আপনি কি পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগে থাকতেন?’ প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করলেন।

‘মনে হচ্ছিল আপনাকে আগে দেখেছি।’ প্রৌঢ়া ভিতরে চলে গেলেন।’

বাড়ি ফিরে নিজেকে আয়নায় দেখলাম। পঞ্চাশ বছর আগের যেসব ছবি আমার আছে তার সঙ্গে একটুও মিল নেই। অথচ চন্দনা, মানে ওই প্রৌঢ়া এমন অসত্য বলবেন কী করে? তার পরেই মনে হলো, অসত্য কেন ভাবছি! সত্তর বছরের মহিলাকে যারা নাম ধরে ডাকতেন তাদের তো এখন বেঁচে থাকার কথা নয়। আমার মতো ওরও মা তাই পঞ্চাশ বছর আগে চলে গিয়েছিল!

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০৯ এপ্রিল, ২০১৬/ রশিদা



এই পাতার আরো খবর