বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
নিরঞ্জন পাল

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গনে অগ্রণী এক বাঙালি

অনুপম হায়াৎ, লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গনে অগ্রণী এক বাঙালি

উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রশিল্পের আবির্ভাব পর্বে হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭) থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পরিবেশে সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) পর্যন্ত যে ইতিহাস, তা বাঙালির দানেই গৌরবান্বিত হয়েছে।  কলকাতা, মুম্বাই, লাহোর, লন্ডন, মিউনিখ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ইতিহাস দেশীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে বাঙালির দানে।  বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের অগ্রণী-দেশ ব্রিটেনকে নিতে হয়েছিল একজন বাঙালির প্রতিভার সাহায্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই কৃতী বাঙালি হলেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের পইল গ্রামের নিরঞ্জন পাল (১৮৮৯-১৯৫৯)। অবশ্য জন্মেছিলেন তিনি কলকাতায় ১৮৮৯ সালের ১৭ আগস্ট। আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫৯ সালের ৯ নভেম্বর।

চলচ্চিত্র আবিষ্কারে কোনো বাঙালির কৃতিত্ব ইতিহাসে না পাওয়া গেলেও সেই নির্বাক ও সবাক পর্বেই যে দুজন বাঙালির মেধা-মনন-শ্রমে সমৃদ্ধ হয়েছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গন, এদের মধ্যে নিরঞ্জন পাল ছাড়াও আরেক কৃতী বাঙালি হচ্ছেন মানিকগঞ্জের হিমাংশু রায় (১৮৯২-১৯৪০)। নিরঞ্জন পালের অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে ব্রিটেন, জার্মানি ও ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রজগৎ।  তিনি কাজ করেছেন বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক, তারকা ও কুশলীর সঙ্গে। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় ছিল তাঁর সৃজনশীল দক্ষতা। তিনি বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান ভাষায় ছিলেন সুদক্ষ।

বংশ ও পরিবার

ভারতীয় উপমহাদেশের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নিরঞ্জন পালের। তাঁর বংশ পাল গোত্র হিসেবে পরিচিত। নিরঞ্জন পালের বংশ ও পরিবার উপমহাদেশের রাজনীতি, সাংবাদিকতা, ব্রতচারী আন্দোলন, প্রশাসন, আইন পেশা, শিল্প-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁর দাদা রামচন্দ্র পাল ছিলেন ঢাকার সাব জজ কোর্টের পেশকার। পরে তিনি আইন পাস করে ঢাকা ও সিলেটে আইন পেশা শুরু করেন এবং মুনসেফ হন। মুনসেফ হিসেবে তিনি যশোর ও বরিশালে দায়িত্ব পালন করেন।

নিরঞ্জন পালের বাবা বিপিন চন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২) ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সুবক্তা, সমাজকর্মী এবং রাজনীতিবিদ। তিনি সম্পাদনা করেন সাপ্তাহিক নিউ ইন্ডিয়া, দৈনিক বন্দে মাতরম, স্বরাজ (লন্ডন), ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট (লন্ডন), পরিদর্শক হিন্দু রিভিউ, ডেমোক্র্যাট, ইনডিপেনডেন্ট, বেঙ্গলী প্রভৃতি পত্রপত্রিকা। এ ছাড়া লিখেছেন অনেক গ্রন্থ। বিপিন পালের বড় ছেলে জ্ঞানরঞ্জন পাল (?-১৯৭৯) ছিলেন লেখক-সাংবাদিক। আর ছোট ছেলে হলেন নিরঞ্জন পাল। বিপিন পালের ছোট মেয়ের জামাই বিপ্লবী ও ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক কুমিল্লার উল্লাস কর দত্ত। নিরঞ্জনের মায়ের নাম নৃত্যকালী। বিপিন পাল বিধবা নৃত্যকালীকে বিয়ে করে সে যুগে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এমন কীর্তিমান পরিবারের সন্তান ছিলেন নিরঞ্জন পাল। নিরঞ্জন পালের স্ত্রী ব্রিটিশ রমণী লিলি। তাদের ছেলে কলিন পাল (?-২০০৫) ছিলেন মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক। কলিন পালের ছেলে দীপ পাল মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গ্রাহক। দীপ পালের ছেলে জয়জিত পাল মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

শিক্ষা

নিরঞ্জন পাল লেখাপড়া করেছেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন, লন্ডন ইউনিভার্সিটি ও কিংস কলেজে (চিকিৎসা শিক্ষা)। শৈশব-কৈশোরে তিনি ছিলেন দুরন্ত। বিদেশি শাসকদের প্রতি ছিল তীব্র ঘৃণা। বিপিন চন্দ্র পাল ছেলেকে চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে লন্ডনে পাঠান সুশিক্ষার জন্য। ওখানে তিনি উগ্রবাদী রাজনীতিবিদ বিনায়ক দামোদর সভারকর, মদনলাল ধিংড়া প্রমুখের সংশ্রবে আসেন। বিপিন পাল ছিলেন রাজনীতিতে উদারপন্থি। কিন্তু নিরঞ্জন পাল ব্রিটেনে অবস্থানকালে চরমপন্থিদের অনুসারী হয়ে ওঠেন। নিরঞ্জনের আইরিশ বান্ধবীও ছিলেন চরমপন্থি। ১৯০৯ সালে মদনলাল ধিংড়া স্যার উইলিয়াম হুট কার্জন উইলিকে হত্যার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নিরঞ্জন প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হন।

সংস্কৃতিচর্চা : চলচ্চিত্র ও নাটক

বিপিন পালের পরামর্শে নিরঞ্জন পাল রাজনীতি ছেড়ে ব্রিটেনের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়েন। নিরঞ্জন লন্ডনের বার্নার্ড শ, ডেভিড গারনেট, ডব্লিউ টি স্টিড, ডয়ারউইকের কাউন্টেশ প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর সংস্পর্শে আসেন এবং লন্ডনের নাট্যমঞ্চে জড়িয়ে পড়েন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি অনেক চলচ্চিত্র ও নাটক দেখেন। ওইসব ছবি ও নাটকে ভারতীয় এবং রেড ইন্ডিয়ানদের বিকৃত চরিত্রায়ণ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং একসময় নিজেই কাহিনি লিখে বিভিন্ন চিত্রপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে থাকেন। ১৯১৩ সালে নিরঞ্জন পাল বুদ্ধদেবের জীবনী অবলম্বনে কাহিনি লিখে পাঠান ব্রিটেনের দ্য ন্যাচারাল কালার সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি নামে চিত্রপ্রতিষ্ঠানে। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার চার্লস আরবান (১৮৬৭-১৯৪২) তাঁকে ডেকে নিয়ে নিজের স্টুডিওতে কাজ দেন। ওখানে নিরঞ্জন হাতে-কলমে চলচ্চিত্রবিষয়ক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং বেতনভুক কুশলী হন।

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় অ্যাম্বুলেন্স কোরে যোগ দেন নিরঞ্জন পাল। ইতোমধ্যে ব্রিটেনের কেন্ট ফিল্মস কোম্পানি তারই কাহিনি ও চিত্রনাট্য অবলম্বনে শুরু করে ‘ফেইথ অব এ চাইল্ড’ ছবির কাজ। এটি ছিল ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘতম ছয় রিলের চলচ্চিত্র। এটি ১৯১৬ সালে মুক্তি পায়। এভাবেই কোনো বাঙালির রচিত কাহিনি ও চিত্রনাট্য নিয়ে বিদেশে তৈরি হয় প্রথম চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি দুই সপ্তাহ ধরে হলে চলে। আর সেই সঙ্গে ভাগ্যের চাকাও খুলে যায় নিরঞ্জনের। প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক রেকস উইলসন তাঁকে এ ফিল্ম কোম্পানিতে আরও কাজ করার সুযোগ দেন।  তিনি ‘ট্রিকস অব ফেট’ নামে চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হন। পরে ‘আলিবাবা’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। নাটকটি লন্ডনের মঞ্চে বহুদিন অভিনীত হয়। এদিকে তাঁর চিত্রনাট্য নিয়ে প্যাথে ফিল্ম কোম্পানির ব্যানারে তৈরি হয় প্রামাণ্যচিত্র ‘এ ডে ইন অ্যান ইন্ডিয়ান মিলিটারি ডিপো’। তিনি ১৯১৯ সালে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ‘ব্রিটিশ অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল কোম্পানি’ নামে চিত্রপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ বছর তিনি লিলি নামে এক ব্রিটিশ মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৯২২ সালে নিরঞ্জন পাল রচিত ‘গডেস’ নাটক লন্ডনে মঞ্চস্থ হয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপর তাঁর লেখা ‘ম্যাজিক ক্রিস্টাল’, ‘হোয়াট এ চেঞ্জ’, ‘হাউস অপোজিট’ নাটকগুলোও লন্ডনের মঞ্চে জনপ্রিয়তা পায়। ঠিক ওই সময় লন্ডনপ্রবাসী মানিকগঞ্জের হিমাংশু রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। পরে নিরঞ্জন-হিমাংশুর বন্ধুত্ব ও যৌথ প্রয়াসে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীখ্যাত চলচ্চিত্র ‘লাইট অব এশিয়া’ (১৯২৪) এবং অন্যান্য চলচ্চিত্র। ওদিকে নিরঞ্জন পালের কাহিনি নিয়ে ‘নিডলেস আই’ নামে আরেকটি চিত্রও ব্রিটেনে মুক্তি পায়।

কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার

ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, নিরঞ্জন পালের কাহিনি ও চিত্রনাট্য অবলম্বনে তৈরি হয়েছে মার্টিন মরনোটন পরিচালিত ব্রিটেনের ‘দ্য ফেইথ অব চাইল্ড’ (১৯৬৬), ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানি প্রযোজিত প্রামাণ্যচিত্র ‘এ ডে ইন অ্যান ইন্ডিয়ান মিলিটারি ডিপো’ (১৯৬৭)।

ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালির মধ্যে সংস্কৃতিকর্মী হিমাংশু রায় এবং তাঁর বান্ধবী রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় দেবিকা রানী চৌধুরীর (১৯০৮-১৯৪৪) সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাঁরা চলচ্চিত্র বিষয়ের ওপর উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে যান। ১৯২৩ সালে নিরঞ্জন ওখানকার এমেলকা কনসার্নের চিত্রনাট্য বিভাগে এবং পরে বার্লিনের উফা কোম্পানিতে যোগ দেন। তাঁর পরিচয়ের বিস্তৃতির ফলে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি চিত্রনাট্য লাইট অব এশিয়া (বুদ্ধদেবের জীবনীভিত্তিক) এমেলকার কাছে বিক্রি করে দেন। এ কাহিনি ও চিত্রনাট্য নিয়ে ১৯২৫ সালে তৈরি হয় ভারত-জার্মানি প্রযোজিত চলচ্চিত্র ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’ বা ‘প্রেমসন্ন্যাস’। ভারতের পক্ষে ছবিটি প্রযোজনা করে হিমাংশু রায়ের ‘গ্রেট ইস্টার্ন ফিল্ম করপোশেরন’ এবং জার্মানির ‘এমেলকা কনসার্ন’। ছবিটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন জার্মানির ফ্রেঞ্জ অস্টেন (১৮৭৬-১৯৫৬) ও হিমাংশু রায়। এ ছবিতে অভিনয় করেন হিমাংশু রায়, সীতা দেবী, রানী বালা, মধু বসু, প্রফুল্ল রায় প্রমুখ। ছবিটি জার্মানিতে মুক্তি পায় ১৯২৫ সালের ২২ অক্টোবর, লন্ডনে ১৯২৬ সালে এবং আমেরিকায় ১৯২৮ সালে। এ ছবি মুক্তির ফলে নিরঞ্জন পালের খ্যাতি আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। নিরঞ্জন পালের কাহিনি ও চিত্রনাট্য নিয়ে মুক্তি পায় ‘সিরাজ’ (১৯২৮), ‘থ্রো অব ডাইস’ (১৯২৯) নির্বাক চিত্র। ১৯৩১ সালে তাঁর চিত্রনাট্য নিয়ে ব্রিটেনে মুক্তি পায় সবাকচিত্র ‘এ জেন্টলম্যান অব প্যারিস’।

১৯২৯-৩০ সালে নিরঞ্জন পাল মুম্বাই ফিরে এসে হিমাংশু রায়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেন ‘ইন্দো ইন্টারন্যাশনাল টকিজ-এ’। এ প্রতিষ্ঠানের হিন্দি ও ইংরেজিতে তৈরি ‘কর্ম’ (১৯৩৩)-এর কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকারও তিনি। ১৯৩৪ সালে হিমাংশু রায় ‘বোম্বে টকিজ’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানেও নিরঞ্জন পাল যোগ দেন কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর কাহিনি ও চিত্রনাট্য নিয়ে নির্মিত হয় ‘জীবন নাইয়া’ (১৯৩৫), ‘জওয়ানি কি হাওয়া’ (১৯৩৫), ‘প্রেমকাহিনি’, ‘অচ্ছুত কন্যা’, (১৯৩৬), ‘জন্মভূমি’ (১৯৩৬), ‘ইজ্জত’ (১৯৩৭), ‘জীবনপ্রভাত’ (১৯৩৭) ও ‘সাবিত্রী’ (১৯৩৭)। এসব ছবি পরিচালনা করেন জার্মানির ফ্রেঞ্জ অস্টেন। তবে তাঁকে নানাভাবে সহায়তা করেন হিমাংশু রায়, নিরঞ্জন পাল ও দেবিকা রানী। নিরঞ্জন পালের চিত্রনাট্য নিয়ে তৈরি বাংলা চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘শুকতারা’ (১৯৪০), ‘হাতেখড়ি’ (১৯৪০), ‘দ্বিতীয় পথ’ (১৯৪১), ‘চিঠি’ (১৯৪১), ‘রাসপূর্ণিমা’ (১৯৪১), ‘ব্রাহ্মণকন্যা’ (১৯৪২), ‘বিজয়ের জের’ (১৯৪২) প্রভৃতি।

চিত্র পরিচালক

চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে নিরঞ্জন পাল মুম্বাই, কলকাতা ও লাহোরের কাজ করেছেন। তিনি কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, সংবাদচিত্র, প্রচারচিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৩০-এর দশকে মুম্বাই এসে কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনার পাশাপাশি চলচ্চিত্র পরিচালনায় জড়িত হন। তাঁর পরিচালনায় লাহোর থেকে ‘ট্রাবলস নেভার কাম এলোন’ (১৯৩০), পুনা থেকে ‘নিডল আই’ (১৯৩১) এবং কলকাতা থেকে ‘পূজারি’ (১৯৩১) ও ‘পরদেশিয়া’ (১৯৩২) এবং ‘এ ফেইথফুল হার্ট’ মুক্তি পায়।

১৯৩৭ সালে তিনি কলকাতায় এসে চা বোর্ড ও অরোরা ফিল্ম করপোরেশনের কয়েকটি খন্ডচিত্র পরিচালনা করেন। অরোরার প্রযোজনায় তিনি ‘হাতেখড়ি’, ‘দ্বিতীয় পাঠ’ ও ‘অন্ধ নাচার’ নামে শিশুচিত্র নির্মাণ করেন। এ ছাড়া নির্মাণ করেন কয়েকটি সংবাদচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র। তেলেগু ভাষায়ও তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ কাহিনিচিত্র নির্মাণ করেন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি ভারতীয় তথ্যচিত্র বিভাগের অনুরোধে লাহোর গিয়ে কয়েকটি প্রচারচিত্র বানান। এসবের মধ্যে ছিল ‘ইন্ডিয়ান মেন অব লেটার্স’, ‘ইন্ডিয়ান মেন অব ইন্ডাস্ট্রিজ’, ‘ইন্ডিয়ান মেন অব সায়েন্স’। এসব চিত্র সরকারি আমলাতন্ত্রের শিকার হয়। পরে তিনি তথ্যচিত্র দফতরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন প্রতিবাদে।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলায় সরকার গঠিত হয়। সরকার একটি প্রচার দফতর খোলে। এ দফতরের অধীনে নিরঞ্জন পাল কয়েকটি প্রামাণ্য ও প্রচার চিত্র নির্মাণ করেন।  এসব চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘ব্লাড ব্যাংক’, ‘ভিলেজ রিকনস্ট্রাকশন’, ‘ভুলের মাশুল’, ‘মেটারস অব মোমেন্ট’, ‘সেলফ রুল ইন বেঙ্গল’ ইত্যাদি।

উপসংহার

নিরঞ্জন পাল ছিলেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের অধিবাসী। অবিভক্ত বাংলা ও উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ও বিকাশ পর্বে তিনি পথিকৃৎ বাঙালি হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গনে বহুমুখী অবদান রেখেছেন। তিনি যেমন ব্রিটেনের প্রথম দীর্ঘতম চলচ্চিত্রের কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, জার্মানি-ভারতের যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র লাইট অব এশিয়ার কাহিনিকার-চিত্রনাট্যকার, তেমন বাংলায় প্রথম শিশুচিত্রের পরিচালক এবং অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা সরকারের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাও। নিঃসন্দেহে নিরঞ্জন পাল বাঙালির গর্ব।  তাঁর চলচ্চিত্রকর্ম আমাদের সংগ্রহ ও সংরক্ষণে থাকা যেমন উচিত, তেমনি সেসব চলচ্চিত্র বারবার অবলোকন করে নির্যাস গ্রহণ করা উচিত। এর ফলে আমাদের জ্ঞান, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হবে।

সহায়ক তথ্যপঞ্জি : একাধিক গ্রন্থ ও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য।

সর্বশেষ খবর