শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের জনগণের জন্য শুভেচ্ছা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বাংলাদেশের জনগণের জন্য শুভেচ্ছা

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী

বিংশ শতাব্দীতে ষাটের দশকে যদি খবরের কাগজে পেশাগতভাবে সাংবাদিকতায় না আসতাম, তাহলে হয়তো অনেক কিছু দেখা হতো না। সে সম্পর্কে রিপোর্টও করতে পারতাম না। খবরের কাগজে কাজে যেমন ঝুঁকি আছে, তেমন মজাও আছে। আর প্রতিটি ঘটনাই একেকটি নতুন অভিজ্ঞতা। আমি রিপোর্ট করেছি ভারতের ষাট দশকের ভয়াবহ জরুরি অবস্থা এবং তার আগে একটি যুদ্ধ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু দেখিইনি, একটানা ৯ মাস ধরে যুদ্ধের উদ্যোগ, পরিকল্পনা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে তা স্বচক্ষে দেখেছে। কার্যত ’৬৪ সালে চাকরিতে ঢুকলেও ’৬৫ সাল থেকে আমাকে রিপোর্ট করতে হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে ভারত-পাকিস্তানের আরেকটি যুদ্ধ। তখন আমি জুনিয়র রিপোর্টার। এ যুদ্ধের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে লাখ লাখ উদ্বাস্তু এ দেশে চলে আসেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও নির্যাতিত হওয়ার নানা খবর। একদিন গেছে, অপরদিন পেট্রাপোল সীমান্তে গিয়ে অত্যাচারিত মানুষগুলোর অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার কথা আমি লিখেছি। ৭০-৭৫ দিন ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করার পর আমার বস আমাকে বলেছিলেন, তুমি অত রাতে আর অফিসে এসো না। শেয়ালদহ স্টেশন থেকে ফোনেই খবর দিও। তাই করেছি।

আগেই বলেছি অভিজ্ঞতার বিরাম নেই। আমরা পশ্চিমবঙ্গে খরা-বন্যা-খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৭ সালে সরকার বদল এবং ১৯৬৯-এ দ্বিতীয়বার বদল, ১৯৭০-এ জোড়াতালি দেওয়া সরকার। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৬৭-তে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে বাংলা কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টরা মিলে।

আর সেই বাংলা কংগ্রেসের প্রধান ছিলেন মেদিনীপুরের অজয় মুখার্জি। এই দলেই যোগ দেন অন্যান্য সম্পাদকের সঙ্গে একজন সম্পাদক হিসেবে বীরভূমের প্রণব মুখার্জি। ১৯৬৬ সালে খাদ্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুই কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি অজয় বাবুর হাত ধরে প্রথম ক্ষমতায় আসে। তারপরে যা হওয়ার তাই হলো।

৯ মাসের মাথায় সরকার ভেঙে গেল। আবার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলো। পরবর্তী নির্বাচন ১৯৬৯ সালে। ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে বামপন্থিরা অজয় বাবুর হাত ধরেই আবার ক্ষমতায় এলেন। নাটকীয় ঘটনার কোনো বিরাম নেই। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি তার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনশন শুরু করলেন। তিনি তখন বলতেন, আমি কুকুর। ঘেউ ঘেউ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের সজাগ করে দিচ্ছি বামপন্থিদের বিরুদ্ধে। এসব রিপোর্ট করতে গিয়ে আমরা ক্লান্ত হইনি। বরং মজাই পেতাম।

আবার ১৯৭০ সালে নির্বাচন হলো। এবার অজয় মুখার্জি ফিরে এলেন কংগ্রেসের হাত ধরে। মুখ্যমন্ত্রী হলেন। উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিবসু। কিন্তু ’৭০ সালের এই সরকার মাত্র তিন মাস টিকে ছিল। ৭ মার্চ থেকেই হাজার হাজার শরণার্থী, উদ্বাস্তু পাকিস্তানিদের অত্যাচারে এ দেশে পালিয়ে আসতে থাকেন। লাখ লাখ লোক এসে গেছে। কলকাতার রাস্তায় তারা পূর্ব পাকিস্তানের নম্বর প্লেট লাগানো গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়েছে। অস্ত্র নিয়ে তারা একদিন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অজয় বাবুর দফতরে ঢুকে বিক্ষোভ দেখান।

সেই সময়কার এত টাটকা খবর আর কোথায় পাওয়া যাবে? মার্চ মাস আমাদের কেটে গেল শুধু ওই মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ে পায়ে হেঁটে খবর সংগ্রহ করতে। এক্সক্লুসিভ খবর করার জন্য প্রতিযোগিতা তখন তুঙ্গে। ইতিমধ্যে ইংরেজি স্টেটসম্যান পত্রিকায়  সম্পাদকীয় লেখা হলো, পাকিস্তান ভাঙার অপচেষ্টা ইন্দিরা গান্ধীকে বন্ধ করতে হবে। এ যেন আগুনে ঘৃতাহূতি দেওয়া। তখন মার্চ গড়িয়ে এপ্রিল মাস। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারা বিক্ষিপ্তভাবে কলকাতা এসে পৌঁছতে লাগলেন। তাদের মুখে একটাই কথা— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন। সবার মুখে একটি কথা। মুজিব কোথায়?

তাজউদ্দীন সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবকে বিএসএফ সীমান্ত থেকেই তাদের জিম্মায় নিয়ে এসে লর্ড সিনহা রোডে বিএসএফ দফতরেই রাখার ব্যবস্থা করলেন। তাদের পরিবাররা তখনো আসেনি। আমার মনে আছে, বস সন্তোষ ঘোষ ফোন করে তার ভবানীপুরের বাড়িতে যেতে বললেন। একটি ট্যাক্সি নিয়ে তার বাড়ি গেলাম। তিনি চিৎকার করে বললেন, রিপোর্টাররা কেন কলকাতায় আছি? কেন আমরা সীমান্তে যাচ্ছি না। বেলা ১১টার মধ্যে সবাইকে অফিসে ডাকা হলো। সবাইকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কে কোন সীমান্তে যেতে চায়। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো কোথায় যেতে চাই। আমি বললাম আমি বালুরঘাটে যাব। বালুরঘাটের একদিকে বগুড়া, অপরদিকে দিনাজপুর জেলা। বালুরঘাট সার্কিট হাউসের সামনে দেখেছিলাম অস্ত্র হাতে কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ। তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমাকে বাংলাদেশের মধ্যে নিয়ে যেতে পারবে কিনা, কয়েকটি তরতাজা যুবক বলেছিলেন, বলুন আপনাকে দিনাজপুরে নিয়ে যাব। আমার সঙ্গে ছিলেন আমাদের প্রধান ফটোগ্রাফার কুমিল্লার সত্যেন সেন। সত্যেনদা আমাকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন এত বড় ঝুঁকি নিবি? আমি বললাম, ঝুঁকি নেওয়ার জন্যই তো এসেছি। যা হওয়ার হবে। মুক্তিবাহিনী আমাদের নিয়ে গেলেন দিনাজপুর শহরে। তখন শীতের বেলা গড়িয়ে গেছে।

মনের মধ্যে তখন ভয় কাটিয়ে অজানাকে জানা আর অচেনাকে চেনার আগ্রহ বেড়েই উঠেছিল। দিনাজপুরে একটি দোকান খোলা পেয়ে বীর সেই যোদ্ধারা আমাদের খাওয়ানোর জন্য নিয়ে গেলেন। দোকানদার বললেন— গত রাতেই খান সেনারা শহরে ঢুকে পড়েছে। আপনারা এখানে থাকবেন না, চলে যান। আমরা ফের ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে জিপ গাড়িতে বালুরঘাটে ফিরে এলাম। দিনাজপুর সফরের কাহিনী পরদিন আনন্দবাজারে প্রকাশিত হওয়ার পর বগুড়ার একদল মুক্তিবাহিনী আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তাদের সঙ্গে বগুড়া যাই। রাজি হয়ে গেলাম। সেই সময়ই হিলি সীমান্ত অতিক্রম করে বগুড়ার পথে এগোচ্ছি। চারদিকে অমাবস্যার অন্ধকার। জিপে বসে দেখতে পাচ্ছিলাম কোথাও কোথাও হারিকেনের আলো। আর কানে আসছিল গোলাগুলির শব্দ। সহকর্মী সত্যেনদা বললেন, দ্যাখ তোর এই ঝুঁকি আমাদের আর কলিকাতা ফিরতে দেবে না।

বগুড়া টাউনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত ১০টা। ফেরার সময় দেখা গেল বিভ্রান্তি। মুক্তিবাহিনী আমাদের যে পথে দিয়ে গেছিল, সেই পথ তারা ঠাহর করতে পারেনি। খানসেনারা আরিচাঘাট পার হয়ে ঢুকে পড়েছিল। তাই তারা অন্য পথ ধরে। সেখানেই হলো বিপত্তি। পথে একটা বিশাল জলভর্তি খাল। জিপ পার হতে পারবে না। হঠাৎ দেখলাম মুক্তিকামী মানুষ দুটি বড় বড় গাছ কেটে ফেললেন। আমাদের হাত ধরে এপারে এনে, তারপর ওই গাছের ওপর দিয়েই পার করানো হলো জিপটি। আমরা যখন এদিক-ওদিক ঘুরে বালুরঘাট সার্কিট হাউস এলাম, তখন ভোরের আলো ফুটেছে। এই অভিজ্ঞতার কথা লিখে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়ার পর, আবার মুক্তিবাহিনী আমাদের বাংলাদেশের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমরা যাইনি। আমাদের কলকাতা ফেরার তাড়া ছিল। কারণ অন্য সীমান্তে যেতে হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখেছি এবং লিখেছি। এক সপ্তাহ পর কলকাতায় ফিরে আসতেই বলা হলো ফোর্ট উইলিয়াম থেকে চিঠি এসেছে, আমাদের কয়েকজনকে তারা ট্রেনিং দেবে। ট্রেনিংও নিলাম। তারপর আমরা যখন সীমান্তে যেতাম তখন খাকি রঙের ইউনিফর্ম পরতে হতো।

উদ্বাস্তুদের ওপর পাকসেনা, আলবদর, আল-শামসের অত্যাচারের রিপোর্ট করেছি। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর সম্ভবত ৬ বা ৭ ডিসেম্বর বনসাঁ থেকে ভারতীয় ট্যাঙ্কে আমরা যশোরের দিকে এগোচ্ছি। যশোরে ঢোকার মুখে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক থেকে গোলা বর্ষণ হচ্ছিল। আমাদের ট্যাঙ্ক থেকে পাল্টা জবাবে পাকিস্তানের তিনটি ট্যাঙ্ক পরপর ঘায়েল করে দেওয়া হয়। তাদের কয়েকজন মারা যায়। বাকি সেনাদের গ্রেফতার করা হয়। ১০ তারিখের মধ্যেই যশোর মুক্ত হয়ে গেল। লিবারেশন সরকারের চার প্রধান যশোরে গিয়ে জনসভা করলেন। সেখানে আমরা শুনেছি ইন্দিরা গান্ধীর নামে জয়ধ্বনি। এদিকে কলকাতায় বসে সেদিন রাতেই ইন্ধিরা গান্ধীর প্রধান সচিব পি এন হাকসার, জেনারেল মানেকশ, পূর্বাঞ্চলের প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা, লিবারেশন সরকারের চার প্রধান এবং ইন্দিরা গান্ধীর নীতিনির্ধারণ কমিটির প্রধান ডিপি ধার বসে ঢাকার মানচিত্র বের করে কোন কোন এলাকায় বেশি সিভিলিয়ান আছে, তা চিহ্নিত করেন, যাতে সেখানে ভারতীয় সেনারা বোমা না ফেলে।

আবার রাত ১০টায় হোটেল হিন্দুস্তানে হাজির হলাম। এক এক করে মিটিং থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমাকে দেখে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আপনি তো সকালে যশোরে ছিলেন। তখন ওদের পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলাম। বিশাল অভিজ্ঞতায় সামান্য হলেও সব লিখতে গেলে মহাভারত তৈরি হয়ে যাবে। এবার ফিরে যাই আমাদের সেই জরুরি অবস্থার দিকে।

জরুরি অবস্থার সময় ব্যক্তিগতভাবে আমিও শিকার হয়েছিলাম। আমার আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছিল। গভীর রাতে আমার বাড়ি তল্লাশি করা হয়েছিল। কিন্তু তখনকার প্রশাসন আমাদের সাহায্য করেছিল। তল্লাশি যে করতে আসছেন, তা আগেই এক অফিসার আমায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। আমি আমার একটা কপি সেনসর না করিয়ে ছেপে দিয়েছিলাম। বিপদ ভয়ানক। কারণ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের দফতর থেকে সম্পাদককে একটি চিঠি দিয়ে বলা হয়েছিল— যেহেতু কপিটি সেনসর করা হয়নি, তাই আনন্দবাজার প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হবে না কেন? চিঠিটি নিয়ে সোজা রাইটার্সে গিয়ে তথ্য সচিব বি আর চক্রবর্তীর ঘরে গেলাম। তিনি আমাদের পুরনো বন্ধু। আমাকে দেখে বললেন, কী মুখ গোমরা কেন। আমি তাকে চিঠিটা দেখালাম। সেটা দেখে তিনি বললেন, ‘ও এই ব্যাপার’। বলে সেটা একটা আলমারি খুলে ফাইলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, যান এ নিয়ে আর চিন্তা করবেন না।

অফিসে ফিরে এসে সম্পাদক অশোক সরকারকে ঘটনাটি জানালাম। তিনি একটু হেসে বললেন, আমি জানতাম আপনিই এটা পারবেন। আমি বললাম, কৃতিত্ব আমার নয়। বি আর চক্রবর্তীর। আমি শুনেছি ব্রিটিশ আমলে সংবাদপত্রের দমনপীড়নে অধিকাংশ কাগজকে নাজেহাল করেছিল। জরুরি অবস্থার সময় সিদ্ধার্থ শঙ্কর যেটাই চালু করেছিলেন। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করার শেষ দিন শান্তিনিকেতনে বসে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন মানু (সিদ্ধার্থ শঙ্করের ডাক নাম) এত অত্যাচার করেছে জানতাম না। সেদিনই তিনি সেনসর শিপ তুলে নেন। এগুলো সবই চাক্ষুষ করা সম্ভব হয়েছে সংবাদিকতায় আসার ফলেই। যা ওই সময় কল্পনাও করতে পারিনি। চলমান ইতিহাসের শুধু ছাত্রই নয়, একজন প্রত্যক্ষদর্শীও হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্মদিনে আমার শুভেচ্ছা রইল।

 

 লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর