শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রবীন্দ্র উপলব্ধি

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

রবীন্দ্র উপলব্ধি

শান্তিনিকেতন, বোলপুর

শান্তিনিকেতনে না এলে রবিঠাকুরকে উপলব্ধি করা যায়? সুরকার আবদুল আহাদ রোজ আসতেন বিকালবেলা মীর্ণাকে গান শেখাতে। গান শেখানোর ফাঁকে শান্তিনিকেতনের কথা, গোগ্রাসে গিলছি আমি। তার প্রতি কথা মনে দোলা দিয়ে যায়। তার সঙ্গে কখনো পৌঁছে যাই লালমাটির পথে বোলপুরে, যেখানে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। মোহরদির [কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়] বাসায় চাতক পাখির মতো মাদুরে বসে থাকি, আর গাই : ‘ওগো কিশোর আজি, তোমার দ্বারে পরাণ মম জাগে’ অথবা ‘আমি যাবই বাণিজ্যেতে যাবই’। মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি কবির ‘ছুটির বাঁশির’ সঙ্গে ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। ভাবতাম অনেক গানের কথা। নানা শিল্পীর কণ্ঠে শুনেছিলাম দিনের পর দিন। আরও যারা, ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেছেন প্রিয় ব্যক্তিরা : কলিম শরাফি, ফজলে নিজামি, মালেকা আজিম খান, আতিকুল ইসলাম। বন্ধু হেনু, ভালো নাম আবুল হেনা সাদউদ্দিন। এসরাজ বাজিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ওরা কেউ নেই। আমি আছি।

ওরা কত ভাগ্যবান। আমি নই। দিনের পর দিন আমার মন ঘুরে বেড়াত ওই মাঠগুলোতে, ওই প্রান্তরে, ওই নদীতীরে। কল্পনার ডানা মেলে আমি উড়ে যেতাম সেই সব জায়গায়, যেখানে আজ আমি হাজির। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া এই গানগুলোর আর তেমন কোনো বিস্তার নেই। ফাল্গুনী, বসন্ত, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা, তখন যেভাবে অভিনীত হতো এখনো তেমনি। নট ও নটিদের বদল। শ্রোতারাও। কত সুন্দর ভঙ্গিমায় নতুন কিশোরীদের নৃত্য আমার হৃদয়ে আনে নতুন দোলা। যেন ওখানেই বসে রবীন্দ্রনাথ, স্থির ছাতিমতলা। শান্তিদেব বলছেন : গুরুদেব, এখানে তো আমের মঞ্জরির গান নেই। রবীন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ, দেখেছি ওই কিশোরীকে, সেই আমের মঞ্জরি। তা থেকে আমরা গাইছি: ‘ও মঞ্জরি, ও মঞ্জরি, আমের মঞ্জরি/আজ হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি’।

পথে পথে থেমে যাচ্ছি আজ। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ওই গাছের তলায়। তাকে দেখতে পাচ্ছি। অনুভব করতে পারছি, শুনতে পারছি তার গান। তোমরা পারছ? আমি শুনছি : ‘কার যেন এই মনের বেদন চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়/ঝুমকো লতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চমকে চাওয়ায়’। গান থেকে গানে সহজেই চলে যেতে পারি। সবগুলো যে চেনা। কতগুলো সুন্দরী আমার দিকে অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে। এ কোন নতুন পথিক। ওদের শোনালাম : ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে এইটুকু কথা শুনি/তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনি’। ওরা অবাক।

এখন বড় বড় পৌষমেলা, অনেক বড় বসন্ত উৎসব। সমগ্র পশ্চিমবাংলায় প্রতিটি শহর মেতে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের গানে, সেখান থেকে বাংলাদেশ, তারপর সমস্ত পৃথিবী। ভক্তিময় দাসগুপ্তের কাছে যখন আমার চয়ন করা রবিঠাকুরের শ্রেষ্ঠ গানগুলো শিখে নেওয়ার প্রয়াস নিলাম তখন থেকে মনের মধ্যে গুঞ্জরিত শান্তিনিকেতনে যাওয়ার সাধ। সবই আমার মনের সমস্ত জায়গাজুড়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথ নেই বিশ্বাস হয় না। এটি আমার নতুন বিশ্বাস শান্তিনিকেতনে আসার পর। উনি বেঁচে আছেন আমাদের প্রতিটি কণ্ঠের বিন্যাসে, আমাদের চেতনায়, শুধু গানে নয়, তার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে রূপ নিয়েছে বোলপুর প্রাণের শান্তিনিকেতনে।

আজ নতুন শান্তিনিকেতন সেজেছে নতুন সাজে। ‘আমিই শুধু রইনু বাকি/যা ছিল তা গেল চলে যা তা কেবল ফাঁকি’। রবীন্দ্রনাথের প্রতি গানের বাণী শন্তিনিকেতনের প্রতিটি গাছের ছায়ায় লুকিয়ে। আমি এতদিন পর নতুন পথিক কি করে পেলাম তার সুগন্ধ, কি করে পেলাম সেই গানের মর্ম আমার নিজের হৃদয়পুরে? রবীন্দ্রনাথ নেই, তা হলে কি করে খুঁজে পেলাম? অনুভবে, ভালোবাসায়। যারা গাইছে নতুন দিনের গায়ক, তারা কি তাকে অনুভবে পেয়েছে? হয়তো পেয়েছে, হয়তো পায়নি। আমি পেয়েছি।

যদি এমন হতো ওখানে পেলাম একটি কুঁড়েঘর, সারা দিন ওই শুকনো পাতার তলা দিয়ে হেঁটে যেতাম। খুঁজতাম তার চরণ চিহ্ন গানের মাঝখানে। প্রতিদিন রবীন্দ্র সংগীতের আসর। কলকাতা থেকে নামিদামি শিল্পীরা গান গাইতে আসেন। কে যেন বলল লোপামুদ্রা এসেছেন, আমি বলি, কই কোথায়, আমি তার গান শুনব। কেউ বলল, স্বাগতলক্ষ্মী এসেছেন, আমি বললাম, আমি তার গান শুনব। কেউ বললেন, শুভমিতা এসেছেন। আমি বললাম, আমি তাকে একটিবার দেখব। আমাদের শ্রেষ্ঠরা, যেমন অদিতি, বন্যা, সব সময় শান্তিনিকেতনের অতিথি। বড় বড় কবিরাও উপস্থিত। কখনো বড় আসরে, কখনো ঘরোয়ায়। যদি এমন হতো আমি বহুদিন ধরে এখানকার বাসিন্দা, তা হলে রোজ গানগুলো শুনতে পারতাম। এমনও হতো আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাও হয়ে যেত। কল্পনায় সব সম্ভব। খানিক একলা ছিলাম একটি পুকুরঘাটে। গাইলাম : ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা নিয়ো হে নিয়ো/হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো’। সবশেষের কথাটি শেষ স্তবকে : ‘এর রসে মিশুক তব নিঃশ্বাস/নবীন ঊষার পুষ্পসুবাস/এরই পরে তব আঁখির আভাস দিয়ো হে দিয়ো’। সব প্রেমের মূল্য লেখা আছে আঁখির কোণে। যে জানে সে জানে। আমি যে ভালোবাসার মানুষ, তাই ভালোবাসার গৃহকেন্দ্র শান্তিনিকেতন আমাকে এমনভাবে টেনেছে।

কয়েকটি মেলা বসেছে। একটি অনির্ধারিত মেলায় আমাকে গান গেতে বলল। গাইলাম লালনের : ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’। এ গান শোনেনি, কিংবা তেমন করে শোনেনি। আসল গান ভালোবাসার। যারা ভালোবাসতে জানে না, তারা এখানে এসে কিছুই পাবে না। গাইলাম নিজের জন্যে : ‘ভালবাসি ভালবাসি/এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি’...। শেষ স্তবক : ‘সেই সুরে বাজে মনে অকারণে/ভুলে যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন হাসি’।

পঞ্চাশ সালে ‘ওইকতান’-এ সবাই মিলে গাইতাম রবীন্দ্রনাথের গানগুলো। ওদের কোথায় হারিয়ে ফেললাম। লাইলি চৌধুরী, তুমি কোথায়? ফারুকুল ইসলাম, তুমি কোথায়? শহীদুদ্ দাহার, তুমি কোথায়? মনিমুননেসা, তোমরা কোথায় হারিয়ে গেলে? হারিয়ে গেল ‘ওইকতান’। এই প্রতিষ্ঠানে আমরা নবশান্তিনিকেতন গড়ে তুলেছিলাম। তা আজ স্মৃতি। ‘ছায়ানট’ হয়নি তখনো। কোথায় না বলে চলে গেলেন ওয়াহিদুল হক ‘ছায়ানট’কে ফেলে? আমরাই রবীন্দ্রনাথকে বুকের মধ্যে বেঁধে রেখেছিলাম। আজও, তা অক্ষুণ্ন।

মামা শ্বশুর সৈয়দ মুজতবা আলী যে বাসায় থাকতেন, দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। তখনকার দিনের চরিত্রগুলো একে একে সামনে এসে হাজির হলো। উপলব্ধির মধ্যে এলো এমন কিছু যা আর কেউ ভাববেন না আজকের দিনে। বাংলার বড় বড় কবি এখানে এসে রবীন্দ্রনাথের হাওয়ায় বেড়ে উঠতেন, তাদের কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পেয়েছি। এরপর আরও অনেকে সেখানে গান শিখতে গিয়েছিলেন। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা থেকে নাতনি আরমীন মুসা। সেই সুযোগ আমার হলো না। পিতা মারা গেলেন, সংসারে ঢুকলাম। কিছুই হলো না জীবনে। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে ধারণ করেছি, যা কারও চেয়ে কম নয়, বরং বেশি।

এবার গিয়ে পৌঁছলাম ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮। প্লেন থেকে গাড়িতে সোজা শান্তিনিকেতন। মাঝখানে শক্তিগড়ের ল্যাংচা। কিন্তু ডায়াবেটিসদের সেখানে গাড়ি থামানোর সুযোগ নেই।

সেই রাতেই গাইলাম এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে একটার পর একটা পিতার ফেলে যাওয়া গান। প্রধান অতিথি রোটারির সর্বাধিনায়ক কল্যাণ ব্যানার্জি। এই গান তারা কোথায় পাবে? ‘ওই না মাধবী বনেতে বন্ধু ছিল সইলো, বন্ধু আমার কোন বনে লুকাইলো’, ‘সোনা বন্ধুরে কোন দোষেতে যাইবা ছাড়িয়া’, ‘আমার গহীন গাঙের নাইয়া’, ‘ও আমার দরদী আগে জানলে’, ‘আগা নাওয়ে ডুবু’, ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’।

পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি বিরাট রোটারি কনফারেন্স অন লিটারেসি। এক সভায় আমি সেশন চেয়ারম্যান। আমি প্রাক্তন গভর্নরদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। রাতের অনুষ্ঠান শুরু এইভাবে : ‘রবিঠাকুরকে গান শোনাতে এসেছি, আর কাউকে নয়’। প্রথম গান : ‘ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি/রেখেছি কনকমন্দিরে কমলাসন পাতি’। সামান্য যন্ত্রানুসঙ্গে। হাজার শ্রোতা মেনে নিলেন ওই রাতে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এসেছিলেন গান শুনতে। গান চলল অনেক রাত অবধি।

 

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর