শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণমাধ্যমের কথকতা

সামিয়া রহমান

গণমাধ্যমের কথকতা

শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর

একবার এক বিদেশি ফিল্ম ডিরেক্টর শুটিং করছিলেন সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে তার দেখা হয় এক বাংলাদেশি মানুষের সঙ্গে। সেই বাঙালি ওই ঘন জঙ্গলেই বাস করত। সেই বাঙালি লোকটা একদিন ফিল্ম ডিরেক্টরের কাছে গিয়ে বলে কালকে বৃষ্টি হবে। দেখা গেল সত্যি সত্যি পরদিন বৃষ্টি হলো। এক সপ্তাহ পর ওই লোক আবার এলো, ডিরেক্টরকে বলল, কালকে ঝড় হবে এবং সত্যি সত্যি পরদিন ঝড় হলো।

বিদেশি ডিরেক্টর বাঙালির প্রতিভায় মুগ্ধ। আসলে বাঙালিরা কি না পারে। এত চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণী যে করে তাকে অবশ্যই তার টিমে চাকরি দিতে হবে। যে বলা সেই কাজ। কিন্তু তারপর দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশি লোকটা আর ডিরেক্টরের কাছে আসে না। ডিরেক্টর একদিন নিজেই গিয়ে বললেন, দ্যাখো কাল আমার খুব বড় একটা সিকোয়েন্স শুটিং করতে হবে। আর এবার আমি তোমার ওপর নির্ভর করছি। তুমি প্লিজ আমাকে বল কালকের আবহাওয়া কি রকম থাকবে?

বাঙালি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, কেমন করে বলব! আমার রেডিওটা তো ভেঙে গেছে। আর কালকে পত্রিকাও বের হবে না।

ঠাট্টা বা জোকস নয়, চারদিকে সংবাদ উৎসবের এই যুগে আজ আসলে সব তথ্যই সহজলভ্য। সব ঘটনাই ভবিষ্যদ্বাণী বা অতীতের দর্পণ হয়ে আমাদের চারপাশে ঝড়ো হাওয়ার মতো উড়ছে। অবশ্য সংবাদের এই ধুলোঝড়ে কোনটি সঠিক আর কোনটি ধুলাময়লা তা খুঁজে বের করা কঠিন। আধিপত্য, চাপ, দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা, উত্তেজনা তৈরির হীনপ্রচেষ্টা প্রায়শই সমাজের দর্পণ আমাদের গণমাধ্যমকে অস্পষ্ট করে ফেলে। বিশ্বাসহীনতা তৈরি করে, সমাজে ঘৃণা, অনাস্থা তৈরি করে। কিন্তু অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে গণমাধ্যম বিকাশের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় এখন আমরা প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছি। যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান ভিত্তি হলো গণমাধ্যম। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়ে গণমাধ্যম সব সময় গণতন্ত্রকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে সেটিই প্রত্যাশিত। আর প্রত্যাশার মাত্রা বেশি বলে সমালোচনার মাত্রাও বোধহয় বেশি।

 এটি খুব স্বাভাবিক সমাজে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা যত বাড়বে, গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীলতা যত বাড়বে, ততই বাড়বে গণমাধ্যমের আধিপত্য। প্রশ্ন হলো ক্ষমতার এই আধিপত্য কীভাবে তার বিশ্বাসযোগ্যতার কাটাছেঁড়ার মধ্যে থেকেও নিজের স্ববিকাশ ঘটিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মানুষের হয়ে কাজ করবে, তার মনোজগতে বিশ্বাস তৈরি করবে। কারণ সমাজের অন্যায়, অবিচার, কপটতা, ভণ্ডামি, দুর্নীতির মুখোশ খুলে দেওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার গণমাধ্যম। কিন্তু সমাজ রাষ্ট্রের অন্যায্যতা তুলে ধরতে গিয়ে গণমাধ্যম তার ক্ষমতার সুবাদে অনেক সময় নিজেই ভারসাম্যের নামে অন্যায় আচরণ করে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা শুধু সাংবাদিকদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। সরকার, মালিকপক্ষ, রাজনৈতিক দল, মুনাফা অর্জনের হীনপ্রচেষ্টাও এখানে ছায়া ফেলে।

রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বলেন, গণমাধ্যম স্বচ্ছ কাচের ঘর। স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকুক বা নাই থাকুক, কাচের ঘর বলেই বোধকরি এর পবিত্রতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি। আচ্ছা বলুন তো গণমাধ্যমের জন্য এই শতকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন কোনটি?

প্রযুক্তি? জনগণের জন্য যদি মাধ্যম হয় তবে আধুনিক প্রযুক্তি বরং গণমাধ্যমকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে সহজেই। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলার দায়ভারের দায়বদ্ধতা তো সেই বিশেষ গণমাধ্যমেরই।

তবে কি নিরপেক্ষতা? আদতে বুকে হাত দিয়ে বলুন তো পৃথিবীতে কেউ কি নিরপেক্ষ? নিজের দেশ বা মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে কি পক্ষ-বিপক্ষ বা নিরপেক্ষতার ধোয়া তোলা যায়! তবে গণমাধ্যম নিরপেক্ষ হবে কোন যুক্তিতে, কার পক্ষতার ভিত্তিতে?

পক্ষপাতিত্ব? রাজনীতি সচেতন এই বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর পক্ষে যে কোনো গণমাধ্যম দেখে বা পড়েই ধারণা করা সম্ভব কোনটি কোন রাজনৈতিক বিশ্বাসের ধারার গণমাধ্যম। তবে এখানেও অস্পষ্টতা প্রবলভাবে বিদ্যমান। কারণ এই বাংলাদেশের মানুষই সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা নিয়ে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল।

তবে কি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতাই বড় চ্যালেঞ্জ? করপোরেট বাণিজ্যের ঘোরপ্যাঁচের ঘোড়দৌড়ের রেসে কে আগে পৌঁছবে তার জন্য গণমাধ্যমের ভালো কনটেন্ট যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জরুরি ভালো দক্ষ মিডিয়া ম্যানেজারের। দুটির সমন্বয় যারা করতে পারবে তাদেরই জয়জয়কার।

একটা সময় ধারণা করা হতো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বোধহয় বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দেবে। কিন্তু যন্ত্র-উৎকর্ষতা যখন সহজলভ্য হলো, বিশ্ব যখন হাতের মুঠোয় এলো, তখনই চিন্তায় মননে হাতের মুঠির বস্তুকে পানসে মনে হতে লাগল। কারণ শুধু যোগাযোগ দিয়ে গণমাধ্যম টিকে থাকতে পারে না। টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো কনটেন্ট বা গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু। চিন্তা করে দেখুন তো আমি জনগণকে গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে যা দিচ্ছি, জনগণ তা নিচ্ছে তো? জনগণ যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পৃক্ত হতে না পারছে, যতক্ষণ নিজেরা গণ হয়ে গণমাধ্যমে প্রবেশ করতে না পারছে, ততক্ষণ কি গণমাধ্যম হাতের মুঠির কনটেন্ট হতে পারছে? আমরা প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছি, কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি তো?

ওই জোকটি মনে পড়ে গেল। এক হকার বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে পত্রিকা বিক্রি করছিল আর চিৎকার করে বলছিল, পত্রিকা কিনুন, দেখুন কীভাবে পঞ্চাশজন মানুষ বোকা হয়ে গেছে, পঞ্চাশ জন। আগ্রহী হয়ে এক লোক পত্রিকাটা কিনে ফেলে। আগাগোড়া পত্রিকা পড়েও এ ধরনের কোনো সংবাদের নামগন্ধও পায় না খুঁজে সে। বিরক্ত হয়ে সে হকারকে বলে, কই পত্রিকার কোথাও তো এই নিউজ নেই। হকার ছেলেটি তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার চিৎকার করে বলে ওঠে, একান্নোজন মানুষ বোকা হয়ে গেছে। একান্নোজন।

আমরা কি দর্শক, পাঠককে বোকা বানাচ্ছি? প্রযুক্তি আমাদের তৃণমূল থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু শুধু প্রযুক্তিগত যোগাযোগই দিয়ে কি গণমানুষের কণ্ঠস্বর হওয়া যায়?

আমরা একটা ট্রান্সজিশন পিরিয়ডের মধ্যে আছি। রাজনীতি নিয়ে অনেক বিভেদ তর্ক-বিতর্ক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তথ্য জানতে চায়, তারা তথ্যসচেতন জনগোষ্ঠী হতে চায়। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্র বা মুদ্রিত গণমাধ্যমের মন্দা চলছে। বিশেষ করে পশ্চিমা উন্নত বিশ্বে অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে বা বিভিন্ন পত্রিকা একীভূত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। জনপ্রিয় বিভিন্ন পত্রিকার প্রচার সংখ্যা কমে গেছে। তবে আশার কথা সাম্প্রতিক একাধিক জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের অনেক দেশে পাঠক সংখ্যা কমলেও এশিয়ায় পাঠক কমেনি। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে সমালোচনা উঠছে দুর্বল কনটেন্ট, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যহীনতা, গতানুগতিকতার অন্ধ অনুকরণের। বলা হচ্ছে ব্যস্ত মানুষ এখন টিভি দেখছে ইউটিউবে, টেলিভিশনে নয়। পত্রিকাগুলো চলে যাচ্ছে এখন অনলাইনে। হাতের মুঠোয় মোবাইলে এখন টেলিভিশন, মোবাইলে এখন পত্রিকা, রেডিও। প্রতিটি মুদ্রিত পত্রিকার অনলাইন ভার্সন আছে। এ যুগে হয়তো শুধু একটি ধারার গণমাধ্যম হয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। জনগণের কাছে পৌঁছতে হলে বিভিন্ন ধারাকে একীভূত করেই টিকে থাকতে হবে।

আশার আলো হচ্ছে গণমাধ্যমগুলো প্রযুক্তি ও সম্ভাবনার তফােক এক করতে চেষ্টা শুরু করেছে। একতরফা বাণী বা সংবাদ দিয়ে জোর করে গেলানোর চেষ্টা না করে, প্রযুক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে জনগণের কথা, জনগণের মাধ্যমেই তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

গণমাধ্যমের আয়না আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সংকট-সম্ভাবনার কথা বলে। বলে স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন পূরণের কথা। বিশ্বায়নের এ যুগে এ স্বপ্ন সম্ভাবনা ছড়িয়ে যায় দেশ থেকে বিদেশে। প্রযুক্তিগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে, সময়কে তুলে ধরে, ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে এক সময় নিশ্চয়ই স্বচ্ছ কাচের এ সত্যনিষ্ঠতার দর্পণ সমাজের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে আমাদের গণতন্ত্রকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে পারবে। পারবে শক্তিশালী হয়ে গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে।

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এ জটিল আত্মসমালোচনা শেষ করতে চাই বরং একটি জোক দিয়েই। একবার এক পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফার বিদেশে একটি কনফারেন্স কাভার করতে গিয়েছিলেন। কনফারেন্স শেষে তারা ঘুরতে বেরিয়েছেন। সমুদ্রের পাশে বালিতে তারা একটি প্রদীপ পড়ে থাকতে দেখে। সম্পাদক সাহেব তার সাংবাদিককে বলেন, জলদি ওটা নিয়ে আস, আলাদিনের চেরাগ কিনা ঘষে দেখ। সাংবাদিক প্রদীপ কুড়িয়ে আনে। আর হাত দিয়ে ঘষা মাত্রই বিরাট দৈত্য এসে হাজির হয়। দৈত্য বলে তোমরা যেহেতু আমাকে ডেকেছ তাই আমি তোমাদের প্রত্যেকের একটি করে ইচ্ছা পূরণ করব। বল তোমাদের ইচ্ছা কী? সাংবাদিক খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে ওঠে, আমি বিশাল বড় বাড়িতে থাকব পত্রিকার সম্পাদক হয়ে। দৈত্য তার ইচ্ছা পূরণ করে। ফটোগ্রাফার বলে ওঠে, আমিও বিশাল বড় বাড়িতে থাকতে চাই সম্পাদক হয়ে। দৈত্য তার ইচ্ছাও পূরণ করে। এবার সম্পাদকের পালা।

বল তোমার কী ইচ্ছা, দৈত্য বলে ওঠে।

আমি ওদের দুজনকেই বিকালের পর ফেরত চাই। আমার কালকের পত্রিকার ডেডলাইন ধরাতে হবে।

যতই সমালোচনা থাকুক না কেন, আমাদের প্রচেষ্টার কিন্তু কমতি নেই। সম্ভাবনা অসীম। আর দিন শেষে আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের সব অভিপ্রায় থাকে সত্যনিষ্ঠতার সঙ্গে জনমানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়া। সে আমরা সফল হই বা না হই। অন্তত সমাজের ওয়াচ ডগ হিসেবে প্রতিনিয়ত আমাদের চেষ্টাটুকু তো আছে।

 

লেখক : হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নিউজ টোয়েন্টিফোর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর