শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
একান্ত সাক্ষাৎকারে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

জীবনে অপ্রাপ্তিবোধ নেই

জীবনে অপ্রাপ্তিবোধ নেই

ছবি : জয়ীতা রায়

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, গবেষক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (জন্ম ১৯৩৭) অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। সম্পৃক্ত থেকেছেন দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে। তিনি গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, ভারতের আনন্দ পুরস্কার, পদ্মভূষণ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিটসহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। তরুণ বয়সে ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর গবেষণা, মৌলিক প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও সম্পাদিত বহু গ্রন্থ রয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

জীবনের আশি বছর পার করেছেন। কোনো অপ্রাপ্তি আছে কিনা?

আমি মনে করি না আমার জীবনে অপ্রাপ্তিজনিত কোনো বেদনা আছে। আমার মনে হয় যে আমি যা আশা করেছিলাম জীবনে তার সবই পেয়েছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশাতীত লাভও হয়েছে। কাজেই অপ্রাপ্তি নেই বলব। শিক্ষক হিসেবে আমি সবচেয়ে উপভোগ করেছি শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্য। বিশেষ করে আমি যখন তরুণ শিক্ষক ছিলাম তখন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেটি সবচেয়ে উপভোগ করেছি। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে এই সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভবপর হয়নি। আমারও বয়স বেড়েছে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বয়সের দূরত্ব বেড়েছে। তাদের সংখ্যা বেড়েছে। সবার সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। সেই দিক থেকে আমি কিছুটা বলতে পারি পরবর্তীকালে ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি। আমি পড়ানোর ক্ষেত্রে ফাঁকি দিইনি। যত্ন করে যে পড়িয়েছি সেটাও একটা উপভোগ্যতার অংশ।

 

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা আপনার রচিত।

ভাষা আন্দোলনের সময় আমার বয়স ছিল পনের। ১৯৫২ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের দফতর সম্পাদক হয়েছিলাম। ঘুর ঘুর করতাম। ওরা লাগিয়ে দিলেন অফিসের কাজে। যখন বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় কাজকর্ম শুরু হলো তখন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ আমাকে বললেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি পুস্তিকা লিখতে হবে। আমি নিজে প্রথমে দ্বিধা করলাম যে, আমি কিই বা জানি যে লিখব। তিনি বললেন, আপনি লেখেন আমি দেখে দেব। আমার মোটামুটি জানা ছিল কোনো কোনো দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। এসব যুক্তিতর্ক দিয়ে ছোট একটি পুস্তিকা। কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ তোহা সাহেবকে বলেছিলেন, একটি পুস্তিকা লিখতে। তিনি সময়ের অভাবে লিখতে পারছিলেন না। ফলে আমার লেখাটাই প্রথম বের হলো। আর পরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের থেকে তোহা সাহেবের জায়গায় বদরুদ্দীন উমর সাহেবকে ভার দেওয়া হয়। তিনিও একটি বই লিখেছিলেন; যা আমার পরে বেরিয়েছিল। আমারটার চেয়ে সেটি বড় এবং ভালো ছিল।

 

একবার অসুস্থ হওয়ায় বঙ্গবন্ধু আপনাকে দেখতে এসেছিলেন।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম ১৯৬৯ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে। তখন কুমিল্লার চান্দিনার কাছে গিয়ে আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হই। ওখানে কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। তো ঢাকায় ফিরে আসার পর নীলক্ষেতে আমার বিশ্ববিদ্যালয় বাসস্থানে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, আওয়ামী লীগের তখনকার প্রচার সম্পাদক আবদুল মান্নান (যিনি পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন) তিনজন আমাকে দেখতে এসেছিলেন। এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা বটেই। আমার মেয়ের বয়স তখন পাঁচ বছর। ওরা স্লোগান দিত ‘আসাদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না, জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব।’ শেখ মুজিব ও আসাদের নাম ওদের কাছে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে দেখে ও আমাকে ফিসফিস করে বলছিল, আসাদ আসেনি। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমার মেয়ে কি বলে? আমি বললাম, ও জিজ্ঞেস করছে আসাদ আসেনি। তখন উনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নিচু হয়ে ওর গাল ধরে বললেন যে, ওরা তো আমার কাছে কৈফিয়ত দাবি করতেই পারে।

 

আপনার বহুল পঠিত ‘মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বইটির সর্বশেষ ভূমিকায় আপনি লিখেছেন, এটি এখন লিখলে আপনি আরও অনেক প্রশ্ন তুলতেন। খেলাফত আন্দোলনকে আপনি ইতিবাচক বলে ভেবেছেন। কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক এসব আন্দোলনের ক্ষতিকর প্রভাব তো পরবর্তী ইতিহাসেও পড়েছে।

‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বইটি পঞ্চাশ বছরের বেশি আগে লেখা। এই পঞ্চাশ বছরে আমি যে বিষয়ে লিখেছিলাম সে বিষয়ে অনেক নতুন গবেষণা, বইপত্র হয়েছে। কাজেই সেসব গবেষণা থেকে যা কিছু নেওয়ার সেটা যদি নিতে পারতাম তাহলে বইটা নতুন করে লিখতে হতো। এখানে একটা উদহারণ দেওয়া হয়েছে খেলাফত আন্দোলন সম্পর্কে। আসলেই খেলাফত আন্দোলন বলে না এই উপমহাদেশে যে ধর্মীয় সমাজ সংস্কার আন্দোলন হয়েছে বা ধর্ম আন্দোলন যেগুলো হয়েছে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে তাহলে দেখা যাবে তার একটা ইতিবাচক ভূমিকা আছে আবার নেতিবাচক ভূমিকাও আছে। যাকে আমরা ওহাবি আন্দোলন বলি তার একটা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিক আছে। আবার এটি অন্য সম্প্রদায় থেকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র করার জন্য কাজ করবে। তেমনি খেলাফত আন্দোলনের একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা আছে। আবার এই যে তুরস্কের খলিফা যিনি একজন স্বেচ্ছাচারী নৃপতি ছিলেন। তার জন্য যে দুঃখবোধ এটি তো নেতিবাচক ব্যাপার এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সেই খেলাফত তো তখন ছিল না। তখন খেলাফত নামেই এটা ছিল রাজতন্ত্র। সেই রাজতন্ত্রের জন্য আমরা সবাই দুঃখ প্রকাশ করলাম এটা নেতিবাচক বলতে হবে। কামাল পাশা তুরস্কে যে নতুন জীবন নিয়ে এসেছিলেন সেটা খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কেউ লক্ষ্য করেননি। ধর্মকেন্দ্রিক আন্দোলনের প্রতিফলন আগেও হয়েছে পরেও হয়েছে এবং সেখানেও একই রকম দেখেছি আমরা। মুসলিম লীগের রাজনীতি এটা ধর্মান্দোলন বলব না কিন্তু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে করা। তার একটা দিকে আছে যে দুর্বল বা দরিদ্র মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। অন্যদিকে সম্প্রদায়। এটিই হিন্দু সংস্কার আন্দোলন সম্পর্ক খানিকটা বলা যাবে। যখন হিন্দুমেলাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ভাবধারা ভিত্তিক আন্দোলন বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে চায় সে আন্দোলন মুসলমান সমাজকে গ্রহণ করেনি বরং তাদের কিছুটা বিরোধিতা করেছিল।

 

আপনার ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ বইয়ে আপনি দেখিয়েছেন, উপনিবেশ শাসন প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই এ অঞ্চলে বাংলা গদ্য ছিল এবং ইতিহাসের অভিজ্ঞতার ভিতর সেটি ক্রমশ স্পষ্ট আকার পাচ্ছিল। আপনার কি মনে হয় ঔপনিবেশিক শাসকের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাংলা গদ্য নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত? 

‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ বইতে আমি যেটা বলেছি যে উপনিবেশের আগে থেকে বাংলা গদ্য ছিল এবং বাংলা গদ্যের এক ধরনের বিকাশ আমরা দেখতে পাই। সেটি আমি মনে করি যে, উপনিবেশের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজস্ব গতিতে চলত যেমন অন্যান্য দেশে হয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় এই গদ্য কিছুটা ভিন্নরূপ ধারণ করেছে এটি আমার মনে হয়েছে। আগের যে ধারা সেটিকে পাশ কাটিয়ে আমরা একটা নতুন ধরনের গদ্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে আরম্ভ করে পরবর্তীকালে সৃষ্টি করলাম। এ গদ্যে নিশ্চয় অনেক গুণ আছে। কিন্তু আমার কথা ছিল যে, আমরা একটা দেশীয় রীতির গদ্য গড়ে তুলেছিলাম সেটি এর মাঝখানে হারিয়ে গেল।

 

দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন।

আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তন আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। বিশেষ করে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে সেটা খুবই সন্তোষজনক। সামাজিক অবস্থারও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রেই কিছু নেতিবাচক দিক আছে। যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে। সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন সত্ত্বেও আমরা দেখি যে, কতগুলো সামাজিক সংকট রয়ে গেছে। যেমন নারীর প্রতি যে আচরণ আমরা দেখছি—এখনো পণের জন্য তাদের নৃশংসতা সহ্য করতে হচ্ছে। এগুলো আমরা কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। তাই সামাজিক পরিবর্তন যা হয়েছে সেটা যথেষ্ট পরিবর্তন নয় এটা আমি বলব। খবরের কাগজের সংবাদ অনুযায়ী বাল্যবিয়ে বেড়েছে। না বাড়লেও খুব যে আমরা কমাতে পেরেছি তা নয়।

 

আপনি কী মনে করেন, সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে।

সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। একটু আগেও সে কথা বললাম। আর এটা কিছুটা অনিবার্য মনে হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে তার একটা স্তর পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধি অল্প কিছু মানুষকে যেমন উপকৃত করে সমাজের সব মানুষকে তা করে না। কাজেই ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার একটা সুযোগ সেখানে থাকে, বেড়েছেও আমাদের দেশে। তবে এটুকু স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা গত দুই দশকে অন্তত আগের চেয়ে ভালো। আমি যখন গ্রামাঞ্চলে যাই, খুব বেশি যাই না। কিন্তু যাতায়াতের পথে যা দেখি—আগে খালি পায়ে খালি গায়ে মানুষ চলত এখন প্রত্যেকের গায়ে একটা কাপড় আছে, পায়ে সান্ডেল আছে স্পঞ্চের হলেও। গ্রামে মাটির বাড়ি প্রায় দেখাই যায় না বলা চলে। এখন টিন এসে গেছে। পাকা বাড়ি, আধাপাকা বাড়ি। কাজেই এই প্রবৃদ্ধির একটা ফল আমরা সেখানেও পাচ্ছি। তবে বৈষম্য দূর হয়নি। বৈষম্য হয়তো একটু বেড়েছে। তবে এ বৈষম্য হয়তো কমিয়ে আনা যাবে।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের মাতৃভাষার ওপর বিদেশি ভাষার চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো নিজেদের মতো ভাষার ব্যবহার করছে। আপনার মতামত কী?

শহর অঞ্চলে আমরা ছেলেমেয়েদের যে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পাঠাচ্ছি তার একটা ফল হলো তারা বাংলা ভাষা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। টেলিভিশনের ফলে হিন্দি ভাষার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা হিন্দি ভাষার শব্দ ব্যবহার করছে। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়েছে বোধহয় এফএম রেডিও। যারা ইচ্ছে করেই বাংলা ইংরেজি আঞ্চলিক শব্দ মিলিয়ে এমন একটি ভাষায় কথা বলে যা কোনো স্বীকৃত ভাষা নয়। এটা শুনে অনেকেই মনে করে যে এইটা বোধহয় ভাষার আধুনিক রূপ। তারা সেটি অনুসরণ করার চেষ্টা করে।

 

রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ভাষানীতি চালু করা যায় কী না।

করা যায় কিন্তু সবাই যে এটা অনুসরণ করবে সেটা বলা মুশকিল। আবার এ রাষ্ট্রীয় ভাষানীতি তৈরি করতে গিয়ে যারা তৈরি করবেন তারা কতটা একমত হবেন সেটাও বলা মুশকিল। তবে চেষ্টা হয়তো করে দেখা যেতে পারে। ফ্রান্সে ফ্রেন্স একাডেমির একটা ক্ষমতা আছে। ফ্রেন্স একাডেমি যে সব শব্দকে স্বীকৃতি দেয় সেগুলো অভিধানে যায় এবং সৃষ্ট সাহিত্যে সেগুলো ব্যবহার করা যায়। আমাদের এখানে এখন ওইভাবে কোনো সংগঠন গড়ে ওঠেনি।

 

বাংলা একাডেমি তো প্রমিত বাংলা বানান রীতি প্রচলন করেছে।

বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বাংলা বানান রীতি মোটামুটিভাবে গৃহীত হয়েছে। তবে এর চেয়ে বেশি করা হয়তো বাংলা একাডেমির জন্য মুশকিল।

 

ভর্তি পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষার গুণগতমান অক্ষুণ্ন রাখতে আপনার পরামর্শ কী?

পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস একটা বড় রকম সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে অনেক বেশি লোক জড়িত বলে মনে হয় এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে এর সঙ্গে কিছু শিক্ষক এখন জড়িত হয়ে পড়েছে। সঙ্গে অভিভাবকরা। এটা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের বড় প্রমাণ। শিক্ষার প্রশ্নটা বাদ দিলেও যারা প্রশ্ন পেয়ে পাস করে যাচ্ছে তারা তো কিছু না শিখে পাশের সনদ পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে সেখানেও তাদের না জেনে পাস করার প্রভাব আমরা দেখতে পাব। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একটা সংকট সৃষ্টি করবে। শিক্ষার গুণগতমান কমছে বলে আমরা বলছি এটা ঠিকই এক অর্থে। শিক্ষার পরিমাণগতমান বেড়েছে। পরিমাণ বাড়লে গুণের ক্ষতি হয় এটা সব সময় বলা হয় এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে সবাই বলছে শিক্ষার মান অবনত হয়েছে। তার মানে এক ধরনের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। আমাদের দেশে আমরা মনে করি যে, সবচেয়ে অবনতি ঘটেছে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে। ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজি বাংলা কোনো ভাষাই ভালো করে শিখছে না। তার কারণ উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। উপযুক্ত উপকরণের অভাব। বিদেশে গেলে দশ মাসে একটা বিদেশি ভাষা ব্যবহারযোগ্যভাবে শেখা যায়। ওই দশ মাসে একটা বিদেশি ভাষা শিখে তারা লেখালেখি করে, অভিসন্দর্ভ লেখে কিন্তু আমাদের দেশে দশ বছর পড়িয়েও ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করাতে পারছে না। কাজেই আমাদের ভাষা শিক্ষা দেওয়ার যে প্রণালি এটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। যেটাকে বলা হয় অডিও ভিজুয়াল মেথড। এটা ব্যবহার করতে পারলে অনেক উপকার হবে। 

 

উচ্চতর পড়াশোনার ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় টেক্সবুক রচনার সুযোগ সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

উচ্চতর পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাংলায় পাঠ্যবই লেখার উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না এর জন্য জ্ঞান বিজ্ঞানে নানা শাখায় যারা শিক্ষকতা করেন তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ তারাই বিশেষজ্ঞ, এসব বিষয়ে তারাই ভালো জানেন। তারাই ওই বিষয়ে বই লিখতে পারেন। তারা যদি আগ্রহবোধ না করেন তাহলে আমরা কাদের কাছ থেকে বই পাব। আমাদের ভাষা শিক্ষার মান এমন নয় যে, আমরা ইংরেজি বই পড়াতে পারব কিংবা ইংরেজি বই পড়ে পরীক্ষায় উত্তর দিতে পারব। কাজেই এখানে বাংলায় উচ্চশিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বড় রকমের অসুবিধা ঘটে যাচ্ছে। এটা দূর করার জন্য সবার চেষ্টা করা উচিত।

 

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কিনা?

বাংলাদেশের গণমাধ্যম আমার মনে হয় অন্য দেশের মতো এর স্বচ্ছতা আছে, জবাবদিহিও আছে। আবার যেহেতু অনেক দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন পত্রপত্রিকা বের হয় সেখানেও আমরা এক ধরনের অস্বচ্ছতাও দেখি। সত্যকে কিছুটা বিকৃত করার চেষ্টাও সেখানে আছে। এ বিষয়ে আমার আলাদা কোনো পরামর্শ নেই। সাংবাদিকরা একটা নীতি মেনে চলে। তারা নৈতিকতার একটা সংহিতা তৈরি করতে পারে। যেটা সবাই অনুসরণ করবেন। তার বাইরে গেলে প্রেস কাউন্সিলের মতো সংগঠনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তবে স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপরে বেশি চাপ যেন না আসে, সেটাও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

 

আপনাকে ধন্যবাদ।

তোমাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ৯ মার্চ ২০১৮, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর