৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৬:১২

ফার্মাসিস্টদের হালচাল

ঋষিমন ভৌমিক মৌলি

ফার্মাসিস্টদের হালচাল

প্রতীকী ছবি

ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট; বছরে লাখো মানুষের জীবন রক্ষায় সর্বদা নিবেদিতপ্রাণ। সহজ করে বললে, ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট; একজন রোগীর স্বাস্থ্যসেবার বিকল্পহীন অবলম্বন। যদিও উভয়ের পেশা খানিকটা আলাদা। তবে উদ্দেশ্য একই! রোগীর সেবা প্রদান। ডাক্তার রোগীর রোগ নির্ণয় করে প্রেসক্রিপশন বা নির্দেশনা প্রদান করে থাকেন। অন্যদিকে সেই রোগের প্রতিষেধক বা ওষুধ তৈরি করা, বিতরণ এবং ব্যবহারবিধি সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া একজন ফার্মাসিস্টের কাজ। শুধু তাই নয়, রোগীর প্রেসক্রিপশন পুনঃপরীক্ষণ এবং ওষুধ তৈরির পর সেটা সংরক্ষণের দায়িত্বটিও পালন করে থাকেন ফার্মাসিস্টরা।

ফার্মাসি বিষয়টি যেহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ওষুধপ্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি পেশাদারি বিষয়, তাই এতে একজন ফার্মাসিস্টের চাপটাও একটু বেশি। কারণ, একজন ডাক্তার রোগ নির্ণয় করে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন। তবে সেই চিকিৎসার পরিপূর্ণতা পায় ওষুধের সঠিক প্রয়োগ এবং কার্যকারিতার ওপর।

ভাবছেন কীভাবে? খেয়াল করলে দেখবেন, রোগী সময়মতো ওষুধ নিচ্ছেন কিনা, ওষুধ প্রয়োগের মাত্রা ঠিক আছে কিনা, ওষুধগুলো ঠিকঠাক সংরক্ষণ হচ্ছে কিনা এসব নির্দেশনা দিতে লাগে একজন ফার্মাসিস্টকে। এ ছাড়াও ওষুধ গ্রহণের সময় কোনো প্রকার সমস্যা অনুভূত কিংবা এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলোও ফার্মাসি বিষয়টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এ কাজটি করেন কেবল একজন দক্ষ ফার্মাসিস্টই।

আমাদের দেশে তিন শতাধিক অনুমোদিত ওষুধ কোম্পানি আছে। যারা আমাদের দেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। মোটকথা এ দেশ ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এসব কোম্পানির উৎপাদন, পণ্য ব্যবস্থাপনা, পণ্য উন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিভাগে স্নাতক ফার্মাসিস্টদের চাহিদাও রয়েছে। এছাড়া শিক্ষকতা, গবেষণা এবং দেশের বাইরে কাজ করার সুযোগও আছে অনেক। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন।দুঃখজনক হলেও সত্য ভালো নেই ফার্মাসি বিষয় নিয়ে স্নাতক অর্জন করা ফার্মাসিস্টরা। গেজেটে বলা আছে, এই পেশায় ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ কথা। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। এমনকি মডেল ফার্মেসিগুলোতেও খুঁজে পাওয়া যায় না দক্ষ ফার্মাসিস্ট। স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ফার্মাসিস্টরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৫০-এর দশকের আগে পূর্ববঙ্গে কয়েকটি দেশীয় ওষুধের উদ্যোগ ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর তাদের প্রভাব ছিল সামান্যই। ১৯৬০-এর দশকে, কয়েকটি বিদেশি এবং দেশীয় উদ্যোগের মাধ্যমে এই বাংলায় ফার্মাসি বিভাগের আগমন। স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প উৎপাদন ও বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ওষুধ আমদানি সীমিত করতে, দেশীয় ওষুধ উৎপাদন বাড়াতে এবং খাত নিয়ন্ত্রণ করতে ১৯৭৪ সালে ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর’ প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ।

দেশে মানসম্পন্ন ওষুধ নিশ্চিত করার জন্য ওষুধ উৎপাদন, বিপণন এবং আমদানি-রপ্তানি অধিকতর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ওষুধ প্রশাসন পরিদফতরকে অধিদফতরে উন্নীত করেন। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।

দেশীয় ওষুধ নীতিমালায় বলা হয়েছে, রোগীকে ওষুধের যথার্থ ব্যবহারবিধি ও সংরক্ষণের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান, ওষুধ বিক্রি, বিপণন, পরিবেশন ইত্যাদি পরিচালিত হবে পেশাগত ফার্মাসিস্টদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। কিন্তু এই নীতিমালা রয়েছে কেবল কাগজে-কলমেই। অন্যদিকে সরাসরি হাসপাতালে রোগীর সেবায় ভূমিকা রাখতে না পারা এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা ফার্মাসিস্টদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ওষুধ উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিভাগে স্নাতক ফার্মাসিস্টদের চাহিদাও ব্যাপক।

আমাদের দেশে এমন পরিস্থিতির দেখা মেলে না। উপজেলা হাসপাতাল এবং মেডিকেলগুলোতে ফার্মাসিস্টদের পদগুলো প্রায় শূন্য। নিয়োগ নেই বললেই চলে। ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী, ৯ম গ্রেডে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের কথা বলা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।

মহামারি মোকাবিলায় গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের ডাক্তার এবং নার্সরাও প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে স্বাস্থ্য খাতের আরেকটি বড় ক্ষেত্র আমাদের বাংলাদেশে বরাবরের মতোই অবহেলিত। এই অবহেলিত খাতটি হলো ফার্মাসি নিয়ে পড়াশোনা করা ফার্মাসিস্ট। যাদের ছাড়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত অসম্পূর্ণ। তাই একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, চিকিৎসা ক্ষেত্রগুলোতে ফার্মাসিস্টদের কাজের পরিধিগুলো বৃদ্ধি এবং তরুণ ফার্মাসিস্টদের মহান এই সেবা প্রদানের সুযোগ করে দেওয়া। পরিশেষে বলব, চিকিৎসাক্ষেত্রে একজন ডাক্তার যেমন খুবই জরুরি, পাশাপাশি একজন ফার্মাসিস্টের ভূমিকাও এক্ষেত্রে অপরিসীম। 

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মাসি বিভাগ, ইন্ডিপেন্ডেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি)।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর