রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ ০০:০০ টা

অবহেলিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন

অবহেলিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশজুড়ে চালিয়েছে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন সিলেটের অসংখ্য নারী-পুরুষ। গণহত্যার পর কোথাও লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, আবার কোথাও উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে লাশের সারি। কোথাও কোথাও হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় লোকজন লাশগুলোর সৎকার করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর এই বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে এরই মধ্যে সিলেটের অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন এবং দখল হয়ে গেছে। সালুটিকর : সালুটিকর বিমানবন্দরের নিকটবর্তী মডেল স্কুলটিকে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানিরা নারী-পুরুষদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানোর পর তাদের হত্যা করত মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। হত্যার পর এসব লাশ মাটিচাপা অথবা পাশর্্ববতী জঙ্গলে ফেলে দিত। স্বাধীনতার পর পরই মডেল স্কুল ও তার আশপাশ বনজঙ্গলে অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ইলাশকান্দি (সদর) : লাক্কাতুরা চা বাগানের অনতিদূরে ইলাশকান্দিতে ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল গণহত্যা চালানো হয়। দেশ স্বাধীনের পরও ইলাশকান্দি বধ্যভূমিতে ১৮ জন শহীদের লাশ গলে দীর্ঘদিন দুর্গন্ধ ছড়িয়েছিল। এখনো এ বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কালাগুল চা বাগান (লাক্কাতুরা) : ১৩ এপ্রিল সকালে পাক সেনারা আসে কালাগুল চা বাগানে। বস্তি থেকে শ্রমিকদের এনে দাঁড় করানো হয় দীর্ঘ লাইনে। তারপর ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। শহীদ চা শ্রমিকদের লাশ পড়ে থাকে ওই স্থানেই। এ বধ্যভূমিটি বাগান কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করে রাখলেও সংরক্ষণের যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মালনীছড়া চা বাগান : বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক শওকত নাওয়াজ ও অন্য নয়জনকে একই জায়গায় দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পাক সেনারা। বাগানের স্টাফ কোয়ার্টারের কাছে রচিত হয় বধ্যভূমি। খাদিমনগর শ্রমিক হত্যা : ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর চা বাগানের শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার কথা বলে এক স্থানে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এতে শহীদ হন ৬৪ শ্রমিক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাগান কর্তৃপক্ষ এই শহীদদের স্মরণে বাগানের প্রবেশপথে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। অনেকটা অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতিসৌধটি। স্টার চা বাগান : '৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি চালিয়ে হত্যা করে রাজেন্দ্র লাল গুপ্তের পরিবারের সদস্য ও বাগানের শ্রমিকসহ ৩৮ জনকে। এদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্বাধীনতার পর বাগান কর্তৃপক্ষ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলেও সরকারিভাবে শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কাঁঠালতলা (বিয়ানীবাজার) : কাঁঠালতলায় শতাধিক কঙ্কাল আবিষ্কার হয় স্বাধীনতার পর। সেগুলো একটি গর্তে মাটিচাপা দিয়ে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানী। আজ এ বধ্যভূমিটির কোনো চিহ্নও নেই। গোয়াইন নদীর তীর : গোয়াইনঘাট বাজারের পাশে নদীর তীরে সাত ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে পাক সেনারা। পরে তাদের লাশ সেখানেই মাটিচাপা দেওয়া হয়। গোয়াইন নদীর তীরের এ গণকবরটির অস্তিত্ব এখন আর নেই। সোনাতিকান্দি (দক্ষিণ সুরমা) : সিলেট-ঢাকা রেললাইনের পাশে সোনাতিকান্দিতে পাক হানাদাররা গুলি চালিয়ে হত্যা করার পর তিন শতাধিক লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। অবহেলা আর অনাদরে পড়ে আছে সোনাতিকান্দি বধ্যভূমিটি। তামাবিল (গোয়াইনঘাট) : এখানে অবস্থান করে পাক সেনারা হত্যা করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা। এদের মধ্যে প্রায় ৫০ জনকে সমাহিত করা হয় এখানে। যুদ্ধের পর দেয়াল নির্মাণ করে গণকবরটি চিহ্নিত করা হলেও এখন এটি অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।

সর্বশেষ খবর