মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ‘প্রক্সি বাণিজ্য’

জড়িত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা

লাকমিনা জেসমিন সোমা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় বেড়েছে প্রক্সি বাণিজ্য। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসে সুবিধা করতে না পেরে ভিন্ন পন্থায় ডিজিটাল জালিয়াতি ও প্রক্সি দেওয়ার চেষ্টা করছে সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে জালিয়াতির অভিযোগে কমপক্ষে ৪০ জনকে আটকও করেছে পুলিশ। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী ছাড়াও এই চক্রের সঙ্গে ছাত্রলীগ ক্যাডার এবং শিক্ষকদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠে এসেছে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত মাসে অনুষ্ঠিত ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে অন্তত ২০ জনকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্য অনুসারে আরও কয়েকজনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। ঢাবির ‘ক’ ইউনিটের পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইসসহ মোহাম্মদপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে হাসিবুল হাসান নামে এক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুসারে জড়িত দুই শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

পুলিশের ডিবি সূত্র বলছে, পরীক্ষা শুরুর আগে বা পরীক্ষা চলাকালীন প্রশ্ন সংগ্রহ করে তাৎক্ষণিক সল্যুশনের মাধ্যমে উত্তরপত্র প্রস্তুত করে জালিয়াতি চক্রটি। এই কাজে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়, যারা টাকার ভাগ পান। আর প্রশ্নপত্র সংগ্রহ ও কাক্সিক্ষত  ভর্তিচ্ছুর কাছে এর উত্তরপত্র পাঠাতে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে মোবাইলে ক্ষুদেবার্তা কিংবা ছবির মাধ্যমে এই কাজটি করেন তারা। এই উত্তরপত্র সরবরাহের জন্য কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তি হয়। সফল হতে পারলে তবেই টাকা। তবে তার আগে চুক্তি অনুসারে ভর্তিচ্ছুদের মূল সার্টিফিকেট তাদের কাছে জমা রাখা হয়। জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা কলেজ ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলকেন্দ্রিক পাঁচটি চক্র রয়েছে- যারা এই ডিজিটাল জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর নেতৃত্বে কিছু ছাত্রলীগ ক্যাডারের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গত ২ নভেম্বর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা চলার সময় জালিয়াতির অভিযোগে জাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি খলিলুর রহমানসহ দুজনকে আটক করে পুলিশে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আটক অপর শিক্ষার্থী জানান, ছাত্রলীগের সহযোগিতায় ৫৫ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রক্সি দিতে এসেছিলেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সারা দেশে তিন ধরনের জালিয়াতি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি চক্র অনেক আগে থেকেই কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ভর্তিচ্ছুদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। এরপর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় এই চক্রটি তাদের দল থেকে প্রক্সি দেওয়ার লোক সরবরাহ করছে। অর্থাৎ আসল পরীক্ষার্থীর বদলে পরীক্ষা হলে বসিয়ে দিচ্ছে তাদের লোক। এমনকি এ ক্ষেত্রে হয়তো মূল পরীক্ষার্থী নিজেই জানছে না তার পরিবর্তে কে পরীক্ষা দিচ্ছে। তার দায়িত্ব কেবল টাকা দেওয়া। অপর একটি চক্র কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, কাজ করছে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই। এই চক্রটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ ক্যাডার এবং সদ্য নিয়োগ পাওয়া কিছু শিক্ষক কাজ করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রক্সিদাতাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের চুক্তির মধ্যস্থতা করছে মূলত ছাত্রলীগ ক্যাডাররাই। আর পরীক্ষা হলে নানাভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করছেন চুক্তিবদ্ধ শিক্ষকরা। এই দুই ধরনের চক্র ছাড়াও ভর্তিচ্ছুদের আত্মীয়স্বজন বা বড় ভাইরাও প্রক্সি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি মাসে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসে সুবিধা করতে না পেরে লাখ লাখ টাকার প্রক্সি বাণিজ্যের চেষ্টা করছে বিভিন্ন জালিয়াত চক্র। রাবির ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে জালিয়াতির সন্দেহে ৫০ জনের একটি তালিকাও তৈরি করে গোয়েন্দা পুলিশ। তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী এবং বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম স্থান পায়। পরবর্তীতে যথারীতি ছাত্রলীগ ক্যাডারসহ জালিয়াতি চক্রের কমপক্ষে ১৫ জনকে আটক করে পুলিশ। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় অন্তত পাঁচজনকে। যদিও দুজন শিক্ষক জড়িত থাকার বিষয়টি পরবর্তীতে স্বীকার করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দেওয়ার ঘটনায় গত শনিবার নাসির হোসেন নামে এক বুয়েট শিক্ষার্থীকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।

সর্বশেষ খবর