মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড

বছর শেষে ছাড়িয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা: নজিবুর রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক

বছর শেষে ছাড়িয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা: নজিবুর রহমান

চলতি অর্থবছরের চ্যালেঞ্জিং টার্গেট নিয়ে নানা মত থাকলেও গত নভেম্বরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রায় ২৩.৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে গত মাসে। আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৬৮.০২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের নভেম্বরে আদায় ছিল ৯ হাজার ৭২৯.৮৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের নভেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের একই মাসে আদায় বেশি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩৩৮.১৫ কোটি টাকা। নভেম্বরের এই প্রবৃদ্ধি রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক লক্ষণ বলে মত পর্যবেক্ষকদের। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের এই আদায়ের ফলে মোট প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের আদায়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪%। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আদায়ের মোট প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৪৪%। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এই হার যথক্রমে ছিল .৫৫%, ৭.৭২% ও ৯.৬০%। তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বিগত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। কারও কারও মতে, এই লক্ষ্যমাত্রা আদায়যোগ্য নয়। এনবিআর সূত্র অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর হতে এ পর্যন্ত এনবিআরের গড় রাজস্ব আদায় ১৫-২০% এর মধ্যে সীমিত ছিল। গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) রাজস্ব আদায়ে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭.২৮%। বর্তমান বছরে এই প্রবৃদ্ধির হার দেওয়া হয়েছে প্রায় ২৯%। অনেক অর্থনীতিবিদ এই টার্গেটকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বললেও এনবিআর বলছে এটি আদায়যোগ্য।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, এনবিআরে বর্তমানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যোগ্য কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে হয়রানি রোধে ব্যবস্থা নেওয়া, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিদের কর আদায়ে সম্পৃক্ত করা এবং রাজস্ব আদায়ে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এটি সম্ভব হবে বলে এনবিআর চেয়ারম্যান প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এনবিআর এখন আর বিক্ষিপ্ত প্রতিষ্ঠান নয়, সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে এটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। যত বেশি কর আদায় হবে এই স্বপ্ন তত বেশি ত্বরান্বিত হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন, সরকারের নতুন পে-স্কেল এবং অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হলেও তা এখন হাতের মুঠোয়।

এনবিআর সূত্র আরও জানায়, গত বছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। গতবছরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর নজির স্থাপন করেছে। বিগত অর্থবছরের আগের তিন বছরে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলেও বর্তমান এনবিআর প্রশাসন নতুন উদ্যোগ ও কর্মকৌশলে গত বছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে ভ্যাট খাতে। ভ্যাট খাতে এই প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৩২.৪৯%। এরপর কাস্টমস খাতে ২৬.৭২%। আয়কর খাতে হয়েছে ১০.৭৭%। আয়কর খাতে সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও নভেম্বরে কম হওয়ার কারণ হিসেবে এনবিআর বলছে দ্বিতীয় প্রান্তিকে কিস্তিতে কর জমা দেওয়ার সময় ডিসেম্বর মাসে। ডিসেম্বরে এই হার বেড়ে যাবে। ভ্যাট খাতে বেশি হওয়ার কারণ কঠোর নজরদারি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে অনাদায়ী রাজস্ব আদায়ে সাফল্য। ভ্যাটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটে। এই কমিশনারেটের নভেম্বরের প্রবৃদ্ধি ১৩৮.৯১%। এরপর বৃহত্ করদাতা ইউনিট আদায় করেছে ৪০.৪৫%। কাস্টমস খাতে চট্টগ্রাম শুল্ক ভবনও তুলনামূলক ভালো করেছে। সবচেয়ে বড় রাজস্ব আদায়কারী এই প্রতিষ্ঠানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭.৮৩%। জানা গেছে, এনবিআর সম্প্রতি বার্ষিক কার্যসম্পাদন চুক্তি (এপিএ), বার্ষিক কৌশলগত পরিকল্পনা, বাজেট বাস্তবায়ন কৌশল (বিআইপি) এবং মাসভিত্তিক পারফরমেন্স মূল্যায়নসহ নানাবিধ কর্মকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। এসবের সুফল হিসেবে চলতি বছরের বাজেটের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই পূরণ হবে বলে দৃঢ়ভাবে আশাবাদ ব্যক্ত করেন চেয়ারম্যান এনবিআর। পাশাপাশি, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বন্ধে এবং বড় বড় রাজস্ব ফাঁকি ও চোরাচালান প্রতিরোধে এনবিআর কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, এর জন্য নানামুখী চাপ ও স্বার্থান্বেষী মহলের অপবাদ ও অপব্যাখ্যা উপেক্ষা করে সত্ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে এবং সব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে এনবিআর এগিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদের অর্থ বিষয়ক ও পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, বিচার বিভাগ, অডিট বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআইসহ সব বাণিজ্য সংগঠনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে আরও জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৪০৭.৬৯ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় ছিল ৪৭ হাজার ৭৩০.০৮ কোটি টাকা। তবে এই সময়ের চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ হাজার ৭১৫.৬০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায়ের এই কম হওয়ার কারণ হিসেবে এনবিআর বলছে, অর্থনীতির গতি অনুযায়ী অর্থবছরের শেষের অংশে রাজস্ব আদায় বেশি হয়ে থাকে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন বছরের শেষের দিকে বেশি হয়। আগের বছরগুলোতে শেষের ছয় মাসে বেশি টার্গেট ধরা হতো। বর্তমান অর্থবছরে কৌশলগত কারণে এবং কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সব মাসে সমান টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে। এনবিআরের কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে বছর শেষে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে। চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআরের সব স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার প্রশংসনীয়।

এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, এনবিআরের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের সম্ভাব্য অন্যতম উত্স হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন, পেট্রোবাংলা ও বিপিসির কাছে সরকারি রাজস্ব বকেয়া প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে একাধিক সভা করা এবং তা আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন আদালতে প্রায় চব্বিশ হাজার মামলায় জড়িত প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এসব টাকা আদায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও বিচার বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে ঝুলে থাকা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) ব্যবস্থা চালু ও তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অর্থবছর শেষে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এসব পদক্ষেপ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর