রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ডিগ্রি আছে মর্যাদা নেই

কূলকিনারা পাচ্ছেন না ডেন্টিস্ট্রির শিক্ষার্থীরা

লাকমিনা জেসমিন সোমা

ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা অনুষদের ‘বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজি (ডেন্টিস্ট্রি) কোর্সের শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চার বছরের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেও প্রকৃত মর্যাদা পাচ্ছেন না। ক্লিনিক্যাল কোর্স পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে টেকনিশিয়ানের সার্টিফিকেট। ফলে দন্ত চিকিত্সা সংশ্লিষ্ট এই ডিগ্রিধারীদের কোনো প্রকার প্রাকটিসের সুযোগ না থাকায় তারা কর্মক্ষেত্রে কূলকিনারা পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, এ অবস্থায় একদিকে যেমন স্নাতক পাস করেও হুমকির মুখে পড়ছে শিক্ষার্থীদের পেশাগত জীবন, অন্যদিকে বাড়ছে শিক্ষিত বেকার। সেই সঙ্গে সম্ভাবনাময় চিকিত্সা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। কোর্স সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোর্সটির গোড়া থেকে চলে আসা এই সংকট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের উপরিমহলের সবাই একমত পোষণ করলেও, সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেউ। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)-এর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রাকটিস তথা কর্মসংস্থানের সুযোগ না দিলে কোনো মূল্যই থাকবে না এ ডিগ্রির। তাদের যৌক্তিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে ভেস্তে গেছে এর কার্যকারিতা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে প্রচলিত ডেন্টাল কোর্সে (বিডিএস) ডিপ্লোমা ডেন্টাল ডিগ্রিধারী মেধাবীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৮২-১৯৮৩ সালের পর থেকে হঠাত্ করে কোনো প্রকার সরকারি আদেশ ছাড়াই বিডিএস কোর্সে ডিপ্লোমা ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর অদম্য চাহিদার ভিত্তিতে ২০০৪-০৫ সেশন থেকে প্রথমবারের মতো ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেসরকারিভাবে ডিপ্লোমা ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের জন্য বিএসসি ইন ডেন্টাল টেকনোলজি (ডেন্টিস্ট্রি) কোর্সটি চালু করা হয়। এই কোর্সটিই পরবর্তীতে ২০১১-১২ সেশন থেকে সরকারিভাবে চালু হয়। কিন্তু কোর্সের নাম ডেন্টাল টেকনোলজি হলেও এর আওতায় পড়ানো হয় ক্লিনিকাল বিষয় নিয়ে। অর্থাত্ একজন বিডিএস কোর্সের শিক্ষার্থীকে যা যা পড়ানো হয়— এই ডেন্টাল টেকনোলোজি কোর্সের শিক্ষার্থীদেরও তাই পড়ানো হয়। একাডেমিক সিলেবাস বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চার বছর মেয়াদি কোর্সটিতে তিন বছর একাডেমিক ও এক বছর ইনকোর্স ট্রেনিং করানো হয়। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে দন্ত চিকিত্সার ওপর এনাটমি, ফিজিওলজি, মাইক্রোবাইওলজি, প্যাথলজি ওরাল অ্যান্ড ডেন্টাল এনাটমি, অর্থডোন্টিক, ওরাল প্যাথলজি, ওরাল মেডিসিন ডেন্টাল কেমিস্ট্রি, চিলড্রেন ডেন্টিস্ট্রি, সার্জারি, জেনারেল অ্যান্ড ডেন্টাল ফার্মলজি, কনজারভেটিভ অ্যান্ড রেডিওলজির মতো বিডিএস কোর্স পড়ানো হয়। এমনকি শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণও দেন এমবিবিএস ও বিডিএস চিকিত্সকরা। এ ছাড়া এক বছর ইনকোর্স ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে এই কোর্সের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিট ও ডেন্টাল কলেজের বিভিন্ন বিভাগ থেকে ডায়াগনসিস, কনজারভেটিভ, সার্জারি, প্রস্থডোন্টিক, অর্থডোন্টিক ও চিলড্রেন ডেন্টিস্ট্রিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। অথচ তারপরও কোর্স শেষে পান ডেন্টাল টেকিনিশিয়ানের মর্যাদা। এমনকি এই নামের কারণেই বিএমডিসি কর্তৃক নিবন্ধিত হতে পারছে না কোর্সটি। ফলে ডেন্টিস্ট বা দন্ত চিকিত্সক হিসেবে প্রাকটিসের সুযোগ পাচ্ছেন না স্নাতক ডিগ্রিধারী এই শিক্ষার্থীরা। এমনকি উচ্চশিক্ষার জন্য দেশে-বিদেশে আবেদন করতে গেলেও সাড়া পান না তারা। সেখান থেকে বলা হয়, এই কোর্সটির বিষয়ে তারা পরিষ্কার নয়। কোর্সের নাম এবং সিলেবাসের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাচ্ছেন না বলেও তারা জানান।

সমস্যার ব্যাপারে একমত, তবু সমাধানে কেউ নেই : কোর্সটি চালুর কয়েক বছর পর থেকেই কর্মক্ষেত্রে তিক্ত অভিজ্ঞতার জের ধরে আন্দোলন শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কোর্সের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগও গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি নয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কমিটি কোর্সটির নাম পাল্টে ‘ব্যাচেলর অব ডেন্টিস্ট্রি’ অথবা ‘বিএসসি ইন ডেন্টিস্ট্রি’ করার সুপারিশ করে। একই সঙ্গে বিএমডিসি কর্তৃক নিবন্ধনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ডেন্টিস্ট হিসেবে প্রাকটিসের সুযোগ দেওয়ারও সুপারিশ করেন কমিটির সদস্যরা। কিন্তু পরবর্তীতে রহস্যজনকভাবে এ সুপারিশ ফের প্রত্যাহার করে নেয় কমিটি। এরপর আবারও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ১৩ অক্টোবর স্বাস্থ্য সচিবের কাছে শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে সুপারিশ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ অক্টোবর অতিরিক্ত সচিব আইয়ুবুর রহমানের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়। সভায় পুনরায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিও শিক্ষার্থীদের পক্ষে সুপারিশ করে। অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবার কোর্সের নাম পরিবর্তনের বদলে সিলেবাস পরিবর্তনের একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে বিএমডিসি এর রেজিস্ট্রার প্রফেসর ডা. বসুনিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের অ্যাক্ট এবং ক্ষমতা অনুযায়ী আমরা ওই কোর্সের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট প্রাকটিসের নিবন্ধন দিতে পারি না। তবে সরকার যদি মনে করে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সেটি করতে পারি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তারা সুপারিশ করেননি। কেবল শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে আমাদেরকে অবগত করতে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। এদিকে বিএসসি ডেন্টাল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন-এর যুগ্ম আহ্বায়ক উত্তম কুমার বলেন, আমাদের দাবি যদি অযৌক্তিকই হয়, তবে হঠাত্ করে সিলেবাস পরিবর্তনের বিষয় এলো কেন? তিনি বলেন, আমাদের প্রাইভেট প্রাকটিস রেজিস্ট্রেশন দিতে তো আর বিএমডিসির টাকা লাগছে না। তাহলে বেকারত্বের বোঝা থেকে যুব ও তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের মুক্তি দিতে এত দ্বিধা কেন তাদের?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অ্যাসোসিয়েশনের অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, বিডিএস ডিগ্রিধারী ও আমাদের কোর্সের মান একই হবে— এই ‘ইগো প্রবলেম’ থেকেই বারবার আমাদের যৌক্তিক দাবিটি ষড়যন্ত্রকারীরা নস্যাত্ করে দিয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর