রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

সমাবর্তনের অপেক্ষায় কয়েক লাখ স্নাতক-স্নাতকোত্তরধারী

তরুণ-তরুণীরা প্রহর গুনছেন

আকতারুজ্জামান

দীর্ঘদিন সমাবর্তন না হওয়ায় বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লাখ স্নাতক-স্নাতকোত্তর তরুণ-তরুণী সমাবর্তনের অপেক্ষায় দিন গুনে চলেছেন। সময়মতো সমাবর্তন না হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসকদের অযোগ্যতা, দায়িত্বহীনতা দায়ী বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছেন। প্রসঙ্গত, শিক্ষাজীবনের ১২টি স্তর পার হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হন উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে। চার বছরের পড়াশোনা শেষে এই শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা থাকে একটি মূল সনদ। সমাবর্তনের মাধ্যমে এই সনদ তুলে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের হাতে। কিন্তু সমাবর্তনের আয়োজন না করে দায়সারাভাবে একটি প্রভিশনাল সার্টিফিকেট (সাময়িক সনদপত্র) দেওয়া হয় অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও পর্যন্ত কোনো সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়নি। গত একযুগেও সমাবর্তন হয়নি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৫ বছরে মাত্র দুবার সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়েছে। এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশই  রয়ে গেছেন সমাবর্তনের বাইরে। ভুক্তভোগীদের মতে, সমাবর্তন মানে শুধু একটি মূল সনদ নয়, সহপাঠীদের সঙ্গে একটি বড় মিলনমেলাও। শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রতিবছরই সমাবর্তন করে একটি মিলনমেলার আয়োজনের মাধ্যমে মূল সনদ শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত, যা শিক্ষার্থীদের করতে পারে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে উদ্যমী। কিন্তু স্নাতক সম্পন্ন করার পরেও সমাবর্তনের দিকে তাকিয়ে থাকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যেমন নিয়মিতভাবে সমাবর্তনের আয়োজন না হওয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী এখনো তাকিয়ে আছে সমাবর্তনের দিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। প্রতিষ্ঠার এক দশক পার করলেও বর্তমানে এ বিদ্যাপীঠ থেকে পাঠ সম্পন্ন করা তরুণ-তরুণীরা সমাবর্তন পাননি। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিটি বিভাগের অন্তত পাঁচটি করে স্নাতক সম্পন্ন করা ব্যাচ বের হয়েছে। তারা সমাবর্তনের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান জানিয়েছেন, অভিজ্ঞ শিক্ষক আর জায়গার অভাবে সমাবর্তন করা যাচ্ছে না। তবে চলতি বছরের জুন ও জুলাই মাসের দিকে সমাবর্তন করার পরিকল্পনা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠার পর ৩৭তম বছরে পদার্পণ করলেও এক যুগে এখানে কোনো সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়নি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র ৩টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ অবস্থার কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীহা ও অযোগ্যতাকে দায়ী করছেন শিক্ষকরা। সমাবর্তন ছাড়াই মূল সনদ প্রদান করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরাও। এ বিষয়ে ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী (স্নাতক পাস ২০১০) মনিরুজ্জামান এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, সমাবর্তন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় উৎসব। এটি একটি মিলন মেলা। ক্যাম্পাস জীবনের সুখ-দুঃখের ঘটনাগুলো মাঝে মাঝেই স্মৃতিকাতর করে তোলে। সমাবর্তন হলে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সঙ্গে আবারও দেখা হতো। মূল সনদপত্র হাতে পেতাম। কিন্তু কিছুই হলো না। এ ব্যাপারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকার বলেন, সমাবর্তন আয়োজনের ইচ্ছে থাকলেও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে সম্ভব হচ্ছে না। আশা করছি শিগগিরই আমরা একটি সমাবর্তন আয়োজন করতে পারব।

১৯৯১ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর গত ২৫ বছরে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র দুবার। ১৯৯৮ সালের ২৯ এপ্রিল প্রথম এবং ২০০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয় সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়েছিল। গত বছরের ১৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩৫তম একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে ওই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে তৃতীয় সমাবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত এর আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৭-এর পর আটটি শিক্ষাবর্ষের প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করলেও তাদের ভাগ্যে সমাবর্তন জোটেনি। এতে ক্ষুব্ধ এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৬-০৭ সেশনের শিক্ষার্থী কাজল দাস বলেন, সমাবর্তন অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্তদের বিশাল মিলনমেলা এবং ছাত্রজীবনের এক বহুল প্রত্যাশিত ক্ষণ। এ থেকে আমাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে। অতিদ্রুত সমাবর্তন আয়োজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমিনুল হক ভূইয়া এ ব্যাপারে বলেন, খুব শিগগিরই সমাবর্তনের আর সুযোগ নেই। তবে দেখা যাক পরে সময়-সুযোগ করে করা যায় কিনা।

দিনাজপুরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হলেও গত ২০১০ সালে প্রথম সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়। এরপর বিভিন্ন বিভাগের অন্তত চারটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্নাতক-স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হলেও তারা সমাবর্তনের সুযোগ পাননি। কবে নাগাদ আগামী সমাবর্তনের আয়োজন করা হবে— এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু জানা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সর্বশেষ সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন বিভাগের অন্তত চারটি শিক্ষাবর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা স্নাতক-স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সমাবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সময়মতো সমাবর্তন না হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তাদের উৎসাহ দিতে প্রতিবছরই সমাবর্তনের আয়োজন করা উচিত। স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় এর উদ্যোগ নেবে। আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির এ ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। কারণ সমাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার মূল সনদ হাতে পায়।

*এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দিনাজপুর প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাহবুব মমতাজী, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান নয়ন ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইকবাল হোসাইন রুদ্র।

সর্বশেষ খবর