শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দূষণে হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য

হুমকিতে কর্ণফুলী নদী ১

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

দূষণে হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য

দেশের অর্থনীতির প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দর গড়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদীর কোলে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই নদী এখন চরম দূষণের কবলে। দৈনিক পড়ছে গড়ে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য। এর মধ্যে আছে সরকারি একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, নগরের ৩০৫টির বেশি শিল্প-কারখানা ও ৬০ লাখ বাসিন্দার আবাসিকের প্রতিদিনের গৃহস্থালি বর্জ্য। পড়ছে জাহাজ ও নৌকার নির্গত তেল, কসাইখানার বর্জ্য, সিমেন্ট ক্লিংকারের পাউডার, নগরীর সলিড ও তরল বর্জ্য। ফলে কর্ণফুলী হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। নষ্ট হচ্ছে পানির মৌলিকতা।

অভিযোগ আছে, কর্ণফুলী নদী-সংলগ্ন কারখানাগুলোর ৯০ শতাংশেরই ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) নেই। ১০ শতাংশের থাকলেও খরচ কমাতে ৫০ শতাংশ কারখানা বন্ধ রাখে তাদের প্লান্ট।

জানা যায়, সিমেন্ট কারখানা ও কালুরঘাটে অবস্থিত ট্যানারিশিল্পের নির্গত বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলীতে। অন্যদিকে রাঙামাটির কাপ্তাই, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও বোয়ালখালী উপজেলার কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক কর্ণফুলীর শাখা-নদী ও খালের মাধ্যমে এসে পড়ছে এ নদীতে। পক্ষান্তরে প্রতি বছর কর্ণফুলী নদী দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে দুই হাজার বিদেশি জাহাজ। প্রতি মাসে গড়ে দেড় হাজার দেশি জাহাজ এ নদীতে চলাচল করে। এসব জাহাজ ব্যাপকভাবে কর্ণফুলী নদীকে দূষণ করছে। দেশি-বিদেশি জাহাজ পরিষ্কার ও মেরামতের সময় ধাতব পদার্থ (জিংক, সিসা, ক্যাডমিয়াম) পানিতে ফেলা হয়। এ ছাড়া বন্দরে আনা ক্লিংকার, জিপসাম, সোডা-অ্যাশ ইত্যাদি খালাসকালে বাতাসে ছড়িয়ে ও পানিতে পড়ে। চট্টগ্রাম ওয়াসা ১৯৬৩ সালে পানি সরবরাহ ও পয়ঃপ্রণালি কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও দীর্ঘ ৬৩ বছরেও পয়ঃপ্রণালি কার্যক্রম চালাতে পারেনি। পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগের সিনিয়র কেমিস্ট মো. কামরুল হাসান বলেন, কর্ণফুলীর দূষণ নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জরিমানা ও সিলগালা করা হয়েছে। তবে দূষণ রোধে আরও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে পরিবেশ অধিদফতর। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও কর্ণফুলী বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। চট্টগ্রাম হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, নগরের ৬০ লাখ মানুষের বর্জ্যের মধ্যে ৪০ শতাংশ সংগ্রহ করে সিটি করপোরেশন। বাকি ৬০ শতাংশ বর্জ্য কোনো না কোনোভাবে গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলীতে। এ ছাড়া ৩৫০টির বেশি শিল্প-কারখানার বর্জ্য পড়ছে এ নদীতে। অধিকাংশ শিল্প-কারখানায় ইটিপির ব্যবস্থা নেই। ফলে ধ্বংস হচ্ছে মাছ, হ্রাস পাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) পরিচালিত কর্ণফুলী পেপার মিল উৎপাদনে যায় ১৯৫৩ সালে। কিন্তু এ কারখানায় এখনো তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি স্থাপন করা হয়নি। গত বছর অক্টোবরে পরিবেশ অধিদফতর নদীদূষণের দায়ে কেপিএমকে ১ কোটি ৮৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। পরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মন্ত্রণালয় তা ক্ষমা করে দেয়। বিসিআইসির প্রধান হিসাব নিরীক্ষক মোবাশেশর ইসলাম বলেন, ইটিপি স্থাপনের কাজ এখন প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ। এটি বাস্তবায়ন করা হলে কর্ণফুলী আর দূষণের শিকার হবে না। এখন নিজেরা পরিশোধন করলেও তা উন্নতমানের নয়। পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দূষণের কারণে কর্ণফুলীর ৩৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ নদীতে ৬৬ প্রজাতির মিঠাপানির, ৫৯ প্রজাতির মিশ্রপানির ও ১৫ প্রজাতির সামুদ্রিক পরিযায়ী মাছ পাওয়া যেত। এখন মিঠাপানির ২০-২৫ আর মিশ্রপানির ১০ প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত। বিলুপ্ত হওয়া মাছের মধ্যে আছে ফাইস্যা, কাঁচকি, রূপচাঁদা, কালিচাঁদা, পাঙ্গাশ, বাচা, ভেটকি, পাশা, লইট্টা, রিকশা, মধু, পাবদা, পোয়া, মহাশোল ইত্যাদি। কমতে শুরু করেছে কাতলা, রুই, মৃগেল। হুমকিতে আছে আরও ২০ প্রজাতির মাছ। গবেষণা সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলীতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রাণ ধারণের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রয়োজন প্রতি লিটারে ৪ থেকে ৬ মিলিগ্রাম। কিন্তু দূষণের শিকার এ নদীর পানিতে ডিও পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ১ থেকে ৪ মিলিগ্রাম। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য এ মাত্রা খুবই বিপজ্জনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নদীর পানিতে জীব-রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদার (বিওডি) আদর্শ মান ২ থেকে ৩ ধরা হলেও বর্তমানে তা রয়েছে প্রতি লিটারে ১০ থেকে ২৫ মিলিগ্রাম। পানির বিদ্যুৎ পরিবাহী (ইলেকট্রিক কন্ডাকটিভিটি) ক্ষমতার সহনীয় মাত্রা প্রতি সেন্টিমিটারে ৭০০ থেকে ২৮০০ মাইক্রো সিমেন্স। কিন্তু এখন রয়েছে প্রতি সেন্টিমিটারে গড়ে ৩৪০০ মাইক্রো সিমেন্স। নদীর রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদার (সিওডি) আদর্শ মান প্রতি লিটারে ২০০ মিলিগ্রাম। কিন্তু এখানে আছে এরও ওপরে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর