বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সেরা পাট উৎপাদনকারী দেশ হলেও ৮০ ভাগ বীজ আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। পাটবীজের এ পরনির্ভরতা কাটাতে সংগ্রাম করছে বাংলাদেশ। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চফলনশীল জাতের পাটবীজ উৎপাদন করার চেষ্টা করছে। এ পর্যন্ত তাদের অর্জন ৯৭১ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন। তবে ভিত্তিবীজের পরিমাণ আরও কম—মাত্র ১৫ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে প্রতিবছর পাটবীজের চাহিদা ৪ হাজার ৫০০ টনের বেশি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পাটবীজের জোগান পাওয়া যায় মাত্র ১ হাজার ২০০ টন। বাকি ৩ হাজার ৩০০ টন পাটবীজ আমদানি করতে হয় ভারত থেকে। এর পরও বিশ্বের পাটের মোট চাহিদার ৭০ ভাগ জোগানদাতা দেশ বাংলাদেশ। জিডিপির ৩.৮৬ ভাগ জোগান দেয় পাট। এ খাতে প্রতি বছর আট হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় বলে জানা যায়। পাট খাতে এ আয়ের পরিমাণ আরও ১০ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে মনে করেন পাটমন্ত্রী মির্জা আজম। তিনি বলেন, এক টন পাটের সুতা রপ্তানি করে ১ হাজার ডলার আয় করা যায়। অথচ এক টন পাটের বহুমুখী পণ্য রপ্তানি করে ১০ হাজার ডলার আয় করা সম্ভব।
জানা যায়, বর্তমানে পাটজাত পণ্যের প্রায় ৬০ ভাগের জোগান দেয় ভারত। শুধু তা-ই নয়, জাতিসংঘের এফএও এবং ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের এক নম্বর পাট উৎপাদনকারী দেশ এখন ভারত। তাদের পাট উৎপাদনের পরিমাণ ১৯ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন। বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ। উৎপাদনের পরিমাণ ১৪ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন। বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে, গত অর্থবছর ১ কোটি ৭৫ লাখ ১ হাজার বেল পাট উৎপাদন করেছে এ দেশের কৃষক। মাটি ও আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট উন্নতমানের। তবে মোট উত্পন্ন পাটের ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ নিম্নমানের বলে এটি রপ্তানিযোগ্য নয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী ও পাটচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বীজ সংকটের কথা। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল জাতের পাটবীজ উৎপাদন বৃদ্ধির নানা উদ্যোগের কথা জানান। তবে পাটচাষিরা সরাসরি দায়ী করেন নিম্নমানের বীজকে। তারা বলেন, বাংলাদেশের কৃষকদের নির্ভর করতে হয় ভারত থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের বীজের ওপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিএডিসির সরবরাহ করা আমদানি বীজের মান ঠিক থাকে না। এ ছাড়া মাত্র ৩৩ শতাংশ চাষি ভালো বীজ পান। এ জন্য ভালো পাট হচ্ছে না। অবশ্য এ বিষয়ে আশার বাণী শোনাল পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। জানা যায়, অল্প খরচে নিম্নমানের পাটের মানোন্নয়ন করে পাটজাত পণ্য উৎপাদনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে তারা। বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হলে এসব পাট থেকে ভালো মানের পাটজাত পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া এসব নিম্নমানের পাট থেকে স্বল্প খরচে ওষুধে ব্যবহৃত মাইক্রোক্রিস্টালাইন সেলুলোজসহ অন্যান্য মূল্যবান পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তারা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৫টি দেশ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আমাদের এখানকার পাটের প্রধান গ্রাহক। এ দেশ থেকে কাঁচা ও প্রক্রিয়াজাত পাট ছাড়াও পাটের তৈরি কার্পেট, চট, পাটের ব্যাগ, বস্তা, ঝুড়ি, বিভিন্ন ধরনের কাপড়, সুতা, তুলা, জুতা, ঘর সাজানোর দ্রব্য বিলাস-সামগ্রীসহ ১০১ ধরনের পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (ডিডিপিসি) তত্ত্বাবধানে পাটজাত পণ্য বহুমুখীকরণের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ২৫০ জন সফল উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এসব উদ্যোক্তা এবং এ দেশের পাটশিল্পের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে প্রতি মাসে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা আয় করছে। এ দেশে বেন্ড কটন থেকে তৈরি ফ্যাব্রিকস সুইজারল্যান্ডে রপ্তানি করে প্রতি মাসে একজন রপ্তানিকারক ১২ লাখ টাকা আয় করছেন। এ ছাড়া বেন্ড কটন থেকে তৈরি বিশেষ ধরনের ৫০ হাজার শপিং ব্যাগ রপ্তানি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ৫০০ বিলিয়ন পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে।পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সম্প্রতি পাটবস্ত্র তৈরির নিমিত্তে চিকন সুতা (১০০ টেক্স) উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। রপ্তানিযোগ্য পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের জন্য কৃত্রিম আঁশের সঙ্গে পাটের আঁশ মিশিয়ে বিভিন্ন পাটজাত বস্ত্র তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে তারা। জুট ও কটনের সংমিশ্রণে উন্নতমানের জিন্স কাপড় তৈরি করা হয়েছে, যা প্যান্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। এ কাপড় তুলনামূলকভাবে টেকসই ও সস্তা। এসব উদ্ভাবিত প্রযুক্তি হস্তান্তর ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন ও বাজারজাত করার লক্ষ্যে এর মধ্যে প্রায় ৩০০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসব্যাপী ৩ কোটি ৩৪ লাখ পাটের ব্যাগ বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া পাটের ব্যাগের বার্ষিক চাহিদা উন্নীত হয়েছে ১০ কোটি থেকে ৭০ কোটিতে।