রবিবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডোনেশনের নামে শিক্ষক নিয়োগবাণিজ্য

নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েও যোগ দিতে পারেননি

আকতারুজ্জামান

বেসরকারি স্কুল-কলেজে বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে আছে বহুদিন ধরেই। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সম্প্রতি একটি ফাজিল মাদ্রাসায় প্রভাষক নিয়োগের জন্য ১০ লাখ টাকা ‘ডোনেশন’ দাবি করা হয়েছে। প্রার্থীর হাতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বর ধরিয়ে দিয়ে মাদ্রাসাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ওখানে টাকাটা জমা দিয়ে আসুন।’ কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়া এই প্রার্থী টাকার বিনিময়ে চাকরি নিয়ে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে কলঙ্কিত করবেন না। তবে ১০ লাখ টাকা জমা না দেওয়ায় তাকে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। ভুক্তভোগী প্রার্থী এমন অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। একই সঙ্গে মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে, পদটিতে কোনো প্রকার ডোনেশন ছাড়াই বিধি মোতাবেক যোগদান করতে চান তিনি।

জেলা সদরে অবস্থিত নীলফামারী আলিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ইসলামের ইতিহাস, আরবিসহ কয়েকটি বিষয়ে প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। প্রায় দেড় বছর পর ১৭ ডিসেম্বর এসব পদে নিয়োগের পরীক্ষা হয়। পরীক্ষায় আরবি প্রভাষক পদে মো. হাবিবুল্লাহ প্রথম ও মো. আবদুল মালেক দ্বিতীয় হন। তৃতীয় হন উম্মে হাবীবা। প্রতিষ্ঠান অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত ফলাফল নোটিস বোর্ডেও টানানো হয়। বিধি মোতাবেক ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই যোগদানের কথা ছিল তাদের। হাবিবুল্লাহর অভিযোগ, ২২ ডিসেম্বর যোগদানের ইচ্ছা পোষণ করে অধ্যক্ষ মো. একরামুল হকের সঙ্গে দেখা করলে তিনি একটি হিসাব নম্বর ধরিয়ে (মার্কেন্টাইল ব্যাংক—১১৭৩১২১১৫২৩৭৫১১) দিয়ে ডোনেশন হিসেবে ১০ লাখ টাকা জমা দিতে বলেন। ডোনেশন ছাড়া নিয়োগপত্র দেওয়া হবে না বলেও জানিয়ে দেন অধ্যক্ষ। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সঙ্গে দেখা করলেও একই কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। যোগদানের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর পার হয়ে গেলেও প্রভাষক হিসেবে যোগদান করতে পারেননি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মো. হাবিবুল্লাহ। পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা মো. আবদুল মালেকও যোগদান করতে পারেননি একই কারণে। তবে পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেও যথাসময়েই প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছেন উম্মে হাবীবা। জানা গেছে, তিনি মাদ্রাসা    অধ্যক্ষ একরামুল হকের কন্যা। মো. হাবিবুল্লাহ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘১০ লাখ টাকা ডোনেশন না দেওয়ার কারণেই আমার চাকরি হয়নি।’ টাকা নিয়ে যদি একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয় তবে শিক্ষকের দায়বদ্ধতাই বা থাকল কি জাতির কাছে, প্রশ্ন রাখেন তিনি। এসব ব্যাপারে জানতে অধ্যক্ষ একরামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ডোনেশনের নামে টাকা দাবির বিষয়টি অস্বীকার করেন। বলেন, ‘নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে গভর্নিং বডি। আমি টাকা চাইব কেন?’ এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। কিন্তু এতেও বন্ধ হয়নি নিয়োগ বাণিজ্য। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) প্রকাশিত মেধা তালিকায় স্থানপ্রাপ্তদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। পূর্ব প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির আলোকে গত বছরের ২৭ অক্টোবর প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির আলোকে গত ৯ অক্টোবর ১২ হাজার প্রার্থীকে বেসরকারি স্কুল-কলেজে চাকরির জন্য মনোনীত করে এনটিআরসিএ। চাকরির জন্য মনোনীত হলেও অনেকেই টাকা ছাড়া যোগ দিতে পারেননি। কোনো কোনো প্রার্থী টাকা ছাড়া যোগদান করতে পারলেও এমপিওর (মান্থলি পে অর্ডার) জন্য টাকা দিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানপ্রধান অথবা গভর্নিং বডিকে। এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করা মুস্তাফিজুর রহমান। প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘টাকা ছাড়া যোগদান করলেও আমার এমপিওর বিষয়টি কৌশলে বিলম্বিত করা হচ্ছে।’ জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় মাহমুদা সালাম মহিলা কলেজে মনোনীত শিক্ষকদের কাছ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বড় অঙ্কের টাকা দাবি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিকার চেয়ে এ কলেজের মনোনীত শিক্ষকরা এনটিআরসিএ’র কাছে আবেদন করেছেন। তারা গত মাসে সরিষাবাড়ী প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তাদের দুর্দশা বর্ণনা করেন। নাম প্রকাশ না করে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার একটি কলেজের প্রভাষক পদে মনোনীত একজন শিক্ষক সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, তিনি যে কলেজে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেখানকার গভর্নিং বডি প্রথমে ৪ লাখ টাকা দাবি করে। এতে অস্বীকৃতি জানালে ২ লাখ নির্ধারণ করে জানিয়ে দেন যে, এ টাকা না দিলে যোগদান করতে দেওয়া হবে না। প্রার্থী কত টাকা দিয়ে যোগদান করেছেন তা বলতে রাজি হননি। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার একটি আলিম মাদ্রাসায় মনোনীত এক চাকরিপ্রার্থী নাম ও প্রতিষ্ঠানের পরিচয় প্রকাশ না করে বলেন, গত ২৯ ডিসেম্বর ছিল যোগদানের শেষ তারিখ। কিন্তু এর এক দিন আগে গেলেও টাকা ছাড়া যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। পরদিন নির্ধারিত টাকা জমা দিয়েই যোগদান করেছেন তিনি। এই প্রার্থীর আরও অভিযোগ, এ ব্যাপারে এনটিআরসিএ’র কাছে অভিযোগ জানিয়েও প্রতিকার মেলেনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর