রবিবার, ৭ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনীতিকদের ছাড়িয়ে গেছেন ব্যবসায়ীরা

এফবিসিসিআই নির্বাচন

রুহুল আমিন রাসেল

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন—এফবিসিসিআই দলীয়করণে রাজনীতিকদের ছাড়িয়ে গেছেন ব্যবসায়ীরা। বিগত বিএনপি সরকার বাণিজ্য সংগঠন আইন সংশোধন করে ব্যবসায়ীদের দলীয়করণের পথে ঠেলে দেয়। তখন থেকে যখন যে সরকার ক্ষমতায়, তাদের রাজনৈতিক শাখায় পরিণত হয় এফবিসিসিআই। তারই প্রভাব পড়েছে এবারের নির্বাচনেও। ৬০ পদের বিপরীতে ৪২ জনই বিনা ভোটে পরিচালক বনে গেছেন, যার ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগের। চেম্বার গ্রুপের ব্যবসায়ীরা ভোটাধিকার হারিয়েছেন। তবে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের বাকি ১৮ পদে ভোট হবে ১৪ মে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভোটের মাধ্যমে সঠিক নেতা নির্বাচিত হলেই ব্যবসায়ীদের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব। তবে ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা উচিত। এখানে দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠা প্রয়োজন। যোগ্যতা ও ব্যবসায়িক সাফল্য বিবেচনা করেই নেতা নির্বাচন করা উচিত বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। জানা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাণিজ্য সংগঠন আইনে সংশোধনী এনে চালু করেন মনোনীত পরিচালক প্রথা। তখন ৬টি বিভাগীয় চেম্বার ও ৬টি অ্যাসোসিয়েশন— এই ১২টি সংগঠন থেকে মনোনীত পরিচালক করা হয়। অর্থাৎ এই পরিচালকরা বিনা ভোটে এফবিসিসিআই পরিচালনা পর্ষদে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন নির্বাচিতদের মতোই। তবে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ হলো, প্রতি বছরই এই মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা বেড়ে এখন ২৪ জনে উন্নীত হয়েছে, যার মধ্যে ১২টি চেম্বার ও ১২টি অ্যাসোসিয়েশন। ফলে বর্তমানের ৬০ পদের বিপরীতে ২৪ জনই বিনা ভোটের মনোনীত পরিচালক। বাকি ৩৬টি পরিচালক পদ নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করার বিধান আছে। তবে চেম্বার গ্রুপের প্রার্থীদের কথিত সমঝোতার কারণে ভোটাধিকার হারিয়েছেন সারা দেশের ব্যবসায়ীরা। ফলে সরকার সমর্থক একমাত্র সভাপতি প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের সম্মিলিত গণতান্ত্রিক পরিষদের চেম্বার গ্রুপের ১৮ জন প্রার্থীই বিনা ভোটে পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের ১৮টি পরিচালক পদের ভোটে ৩৬ প্রার্থীর মধ্যকার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে। অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের অন্য প্যানেল ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সঙ্গে ভোটযুদ্ধ করতে হচ্ছে সম্মিলিত গণতান্ত্রিক পরিষদের।এবার নির্বাচনে মনোনীত হয়ে আসা এবং সরাসরি ভোটে অংশ নেওয়া পরিচালক প্রার্থীদের তালিকা খতিয়ে দেখা গেছে, রাজনীতির মাঠে মতবিরোধ থাকলেও প্যানেল তৈরিতে তার প্রতিফলন নেই। এই নির্বাচনে যেমন অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা, তেমনি আছেন বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির নেতা এবং সমর্থকরা। তবে দলীয় পরিচয় থাকলেও তাদের ব্যবসায়িক নেতৃত্ব গুণাবলি সব মহলে প্রশংসিত। এই নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী একসময়ের ছাত্রলীগ নেতা শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বিজিএমইএ’র সাবেক সফল সভাপতি। আর চেম্বার গ্রুপ থেকে নির্বাচিত পরিচালক শেখ ফজলে ফাহিম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য। তার নেতৃত্ব ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী মহলে আলোচিত-প্রশংসিত। তবে বাগেরহাট চেম্বার থেকে আসা হাসিনা নেওয়াজের রাজনৈতিক অবস্থান জানা যায়নি। চেম্বার গ্রুপে আওয়ামী লীগ সমর্থক অন্য পরিচালকরা হলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মমতাজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে বগুড়ার মাসুদুর রহমান, সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা মুকুটের ছোট ভাই খায়রুল হুদা, বরিশালের নিজাম উদ্দিন, চুয়াডাঙ্গার দিলীপ কুমার আগারওয়ালা, কুমিল্লার মাসুদ পারভেজ খান, ফেনীর এ কে এম শাহেদ রেজা, গাজীপুরের আনোয়ার সাদাত সরকার, জামালপুরের রেজাউল করিম রেজনু, কিশোরগঞ্জের গাজী গোলাম আসরিয়া, মানিকগঞ্জের তাবারাকুল তোসাদ্দেক হোসেন খান, মুন্সীগঞ্জের কহিনুর ইসলাম, নরসিংদীর প্রবীর কুমার সাহা, নোয়াখালীর মো. আতাউর রহমান ভূঁইয়া ও সিরাজগঞ্জের মো. রিয়াদ আলী। রাঙামাটির মো. বজলুর রহমান আওয়ামী লীগ ঘরানার না হলেও তার ভাই ছিলেন বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আজিজুল হকের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।অন্যদিকে চেম্বার থেকে মনোনীত পরিচালক শারিতা মিল্লাত এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ে। রাজশাহী চেম্বারের মো. মনিরুজ্জামান বিএনপির নেতা। আর সিলেট চেম্বারের সালাহ উদ্দিন আলী আহমেদ বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগ সমর্থক অন্য পরিচালকদের মধ্যে আছেন ঢাকা উইমেন চেম্বারের নাজ ফারহানা আহমেদ, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বারের প্রীতি চক্রবর্তী, বরিশাল চেম্বারের সুজিব রঞ্জন দাস, চট্টগ্রাম চেম্বারের মাহবুবুল আলম, ঢাকা চেম্বারের এ কে এম আতফাব উল ইসলাম, খুলনা চেম্বারের কাজী আমিনুল হক, রংপুর চেম্বারের মো. মোসাদ্দেক হোসেন। তবে এমসিসিআইর গোলাম মাইনুদ্দিন ও বিসিআইর সালাহ উদ্দিন আলমগীর পেশাদার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। এদিকে অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের মনোনীত পরিচালক বীমা অ্যাসোসিয়েশনের শেখ কবির হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়। বেসিসের সাবেক সভাপতি শামীম আহসান প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠজন। বিকেএমইএ’র এ কে এম সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির এমপি হলেও সবাই তাকে আওয়ামী লীগার হিসেবে জানে। ওষুধ শিল্প সমিতির এস এম শফিউজ্জামান বিএনপিমনা। অন্য আওয়ামী সমর্থকরা হলেন বিজিএমইএ’র শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, জুট মিলস সমিতির মোহাম্মদ শামস-উজ জোহা ও রিহ্যাবের আলমগীর শামসুল আলামিন; বায়রার মোহাম্মদ ফারুক, হিমায়িত খাদ্য সমিতির কাজী বেলায়েত হোসেন। তবে বিটিএমএ’র তপন চৌধুরী, ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের নজরুল ইসলাম মজুমদার, প্লাস্টিক সমিতির ইউসুফ আশরাফ পেশাদার ব্যবসায়ী। অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপে সরকার সমর্থক সম্মিলিত গণতান্ত্রিক পরিষদের প্রার্থী হিসেবে আছেন ভাষা আন্দোলনের নেপথ্য কারিগর ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদুল্লা কায়সারের কন্যা জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সার। এফবিসিসিআই নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার, অধ্যাপক আলী আশরাফের পুত্র আওয়ামী লীগ নেতা মুনতাকিম আশরাফ। ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে রাশিদুল হোসেন চৌধুরী রনি। বিএনপি ঢাকা দক্ষিণ মহানগর কমিটির সহসভাপতি আবু মোতালেব ও আবুল আয়েস খান।

 আবদুল হক জামায়াত-ঘনিষ্ঠ আর শাফকাত হায়দার সমর্থক হিসেবে পরিচিত। আনোয়ার হোসেনকে ফ্রিডম পার্টির লোক বলা হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থক অন্য প্রার্থীরা হলেন খন্দকার ময়নুর রহমান জুয়েল, নিজাম উদ্দিন রাজেস, এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন, আমজাদ হোসেন, শফিকুল ইসলাম ভরসা, হাফেজ হাজী মো. হারুন, আবু নাসের ও মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ। তবে হাবিব উল্লাহ ডন পেশাদার ব্যবসায়ী হিসেবেই পরিচিত। অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপে ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের প্রার্থী ড. কাজী এরতেজা হাসান, মনজুর আহমেদ, মিজানুর রহমান বাবুল সরকার-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। আর বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে আছেন ওবায়দুর রহমান, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী খোকন, এনায়েত হোসেন চৌধুরী। আওয়ামী সমর্থকরা হলেন মোহাম্মদ পলাশ উল্লাহ, শফিকুর রহমান ভুঁইয়া, তাহের আহমেদ সিদ্দিকী, ডা. মাহবুব হাফিজ, ফেরদৌস হুদা চৌধুরী, আমির উদ্দিন বিপু, আলী জামান ও রব্বানী জব্বার। মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের পরিবার মুসলিম লীগ-ঘনিষ্ঠ, তার পিতা মন্ত্রীও ছিলেন। তবে ইসহাকুল হোসেন সুইট, এম জি আর নাসির মজুমদার, হেলেনা জাহাঙ্গীর পেশাদার ব্যবসায়ী হিসেবেই পরিচিত।

সর্বশেষ খবর