শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

খাল খননেই ‘ঘুরপাক’ খাচ্ছে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরের বৃহত্তর একটি এলাকার পানি পরিবহন করে চাক্তাই খাল। কিন্তু এ খালের সঙ্গে যুক্ত হওয়া শাখা খালগুলো দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। দখল-ভরাটের কবলে পড়ে পানি চলাচল করতে পারছে না। পক্ষান্তরে নগরের বৃহত্তর আগ্রাবাদ ও পতেঙ্গা এলাকার পানি প্রবাহিত হয় মহেশখাল দিয়ে। কিন্তু এটি বর্তমানে খালের ‘সংজ্ঞায়’ নেই। দেখলেই মনে হবে পরিত্যক্ত একটি জঙ্গল। আগাছা, কচুরিপানাসহ নানা আবর্জনায় ভরপুর। এ খাল দিয়েও পানি প্রবাহিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেবল এ দুটি খাল নয়, নগরের ছোট-বড় ৩৪টি খালেরই অভিন্ন অবস্থা। দখল-দূষণের প্রতিযোগিতায় সব খালই এখন মৃতপ্রায়। অস্তিত্ব হারানোর পথে এসব খাল। একসময়ের খরস্রোতা যেসব খাল দিয়ে নৌকা চলাচল করত, এখন সেগুলোর বেহাল অবস্থা। ভরাট, দখল-দূষণ, আবর্জনা, অবাধে পাহাড় কাটা ও পাইলিংয়ের মাটির কবলে পড়েছে চট্টগ্রামের সৌন্দর্যবর্ধিত এসব খাল। এসব খাল খননেই ঘুরপাক খাচ্ছে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন। গত ১৪ বছরে প্রায় ৩০৪ কোটি টাকা কেবল খাল খননেই ব্যয় করা হয়। তবুও অবস্থা অপরিবর্তিত। ফলে পানি চলাচলের সুযোগ না থাকায় নগরে দ্রুত পানি জমে যাচ্ছে। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। গত বুধবারও নগরের অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল পানির নিচে ছিল। নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নগরের খালগুলো যদি অন্তত পানি প্রবাহিত হওয়ার মতো উপযুক্ত থাকত, তাহলে জলাবদ্ধতা অনেকাংশেই কমে যেত। খাল ও নালা-নর্দমা পরিষ্কার না থাকার কারণেই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, অন্তত খাল, নালা ও ড্রেনগুলো যদি পানি চলাচলের সুযোগ থাকত, তাহলে জলাবদ্ধতার পরিমাণ এমন হতো না। তাই আমরা মনে করি, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল ও নালাগুলো পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি।

চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাক বলেন, ‘প্রতি বছরই খালগুলো খনন করা হয়। তার পরও নানা কারণে অনেক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারছে না। তবে এ বছর খাল খনন নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মহেশখালে বর্তমানে চারটি স্কেবেটর একসঙ্গে খননকাজ করছে। তা ছাড়া অন্য খালগুলোও সংস্কার করা হচ্ছে।’ চসিক সূত্রে জানা যায়, নগরে আছে ১৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ছোট-বড় ৩৪টি খাল। প্রতিটি খালই হারিয়েছে তার প্রশস্ততা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চাক্তাই খাল, মির্জা খাল, রাজা খাল, বিবি মরিয়ম খাল, চশমা খাল, নাছির খাল, বির্জা খাল, খন্দকিয়া খাল, কাজির খাল, গয়নাছড়া খাল, বামনশাহী খাল, কাট্টলী খাল, ত্রিপুরা খাল, ডোম খাল, শীতল ঝরনাছড়া খাল, মায়া খাল, হিজড়া খাল, মহেশখাল, ডাইভারশন খাল, মরিয়ম বিবি খাল, সদরঘাট খাল, রামপুরা খাল, পাকিজা খাল, মোগলটুলী খাল।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চাক্তাই খালের বহদ্দারহাট মোড়ের প্রাইমারি স্কুলের পাশের অংশে খালের পাড়ে আছে মাটির স্তূপ। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার, কালারপুল ও খতিবের হাট হয়ে যাওয়া মির্জা খালটির চান মিয়া রোড অংশে প্রায় পুরোভাগ দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে স্বয়ং চসিক। এখানে স্থাপিত হয় চসিকের রাজস্ব সার্কেল-২। ভবনের উত্তর পাশের অধিকাংশ খালই বেদখল। বদর খালের ওপর চসিক একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেছে। একপাশে খালের রেলিং, আরেক পাশে বিভিন্ন ভবন। স্বাধীনতার আগে এই খালের ওপর দিয়ে নৌকা চলাচল করলেও এখন পানি নিষ্কাশনও দুরূহ। চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ খালটি হলো চাক্তাই খাল। বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত সাড়ে ৫ কিলোমিটারের খালটি এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে সিটি করপোরেশন যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে খালের তলা পাকাকরণের মতো একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করায় নগরবাসী মূলত জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন। চাক্তাই খালের পাশের রাজার খালের কর্ণফুলীর মুখ অংশেও চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। মির্জা খালের মুরাদপুরের দক্ষিণে, মির্জা পুলের পূর্বে ৪০-৫০ ফুটের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভরাট, দখলদারদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছে ওই খালটিতে। চাক্তাই খালের চকবাজার কাঁচাবাজার অংশ আবর্জনায় ভরাট। পানি চলাচল হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। চাক্তাই খালের ডিসি রোড, দেওয়ান বাজার অংশের অবস্থা চরম বেহাল। কর্ণফুলী নদীসংলগ্ন বিবি মরিয়ম খালটির অস্তিত্ব এখন প্রায়বিলীন। নতুন নির্মিত ব্রিজের দক্ষিণে দখল করে হয়েছে বহুতল ভবন। ভরাট হওয়া খালে দখলদাররা স্থাপন করেছে টয়লেট। কর্ণফুলী থেকে পাথরঘাটা পর্যন্ত অংশের খালটি দেখলে মনে হবে একটি জঙ্গল। আগ্রাবাদের নাসির খাল দখলে নিয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। আগ্রাবাদ সরকারি কমার্স কলেজ হোস্টেলের পেছন দিয়ে যাওয়া খাল দখল করে গড়ে উঠেছে নানা বসতি। এ খালের অধিকাংশ অংশই অবৈধদের দখলে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর