চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রতি বছরের ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল-মে নগরের খাল, ড্রেন ও নালা সংস্কার করে। নিয়ম মতে, এ বছরও সংস্থাটি কাজ শুরু করে। কিন্তু গত ২০ মার্চ চসিক ঘোষণা করে, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় এ বছর খাল খনন করবে না।’ পক্ষান্তরে চউক এখন পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসনের মেগা প্রকল্পের কাজটি শুরুই করেনি। এমতাবস্থায় নগরবাসীর শঙ্কা, আগামী বর্ষা মৌসুমে নগরের অতীতের চেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা হবে। কারণ অতীতে চসিক খাল খনন করে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করত। কিন্তু এবার খাল-মাটি ও ড্রেন সংস্কার করা হয়নি। ফলে ভরাট হয়ে গেছে পানি চলাচলের এসব মাধ্যম। বাধাগ্রস্ত হবে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ। চসিক-চউকের সমন্বয়হীনতায় এমনটি হবে বলে আশঙ্কা নগরবাসীর। এজন্য তারা আতঙ্কিত। চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা বলেন, ‘নগরীর জলাদ্ধতা নিরসনে চউক ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এমন অবস্থায় জলাবদ্ধতা নিরসনের খাল খনন ও নালা-নর্দমা পরিষ্কারের কাজটি চসিকের করার কোনো সুযোগ নেই। জলাবদ্ধতা নিরসন সংক্রান্ত কোনো কাজে চসিক সম্পৃক্ত হলে তা পুনরাবৃত্তি হতে পারে। পরে আর্থিক অপচয়ের কারণে অডিট আপত্তিও আসতে পারে।’ চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী সুদীপ বসাক বলেন, ‘নিয়ম মতে, চসিক গত ৭ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত ৫৭ খালকে ৬ জোনে ভাগ করে খনন কাজ শুরু করে। এর মধ্যে চাক্তাই খাল, মহেশ খাল, হিজড়া খাল, শিতল ঝরনা খাল, ত্রিপুরা খাল, মির্জা খাল ও নয়া মির্জা খালে দৈনিক প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ শ্রমিক কাজ করছিল। খনন কাজে ছিল ২০টি স্কেবেটর। চসিকের খরচ হয় প্রায় তিন কোটি টাকা। কিন্তু পরে সিডিএ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি আসলে দ্বৈত কাজ হওয়ায় চসিক মাটি খনন কাজ বন্ধ করে।’
চউকের প্রধান প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে আগামী জুন পর্যন্ত নগরীর নিচু এলাকার খাল খনন কাজের জন্য প্রথম দফায় ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যাবে। যা এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের পর্যায়ে আছে। এই বরাদ্দ পেলে প্রাথমিক কাজ শুরু হবে।’
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা ইসলাম বলেন, ‘যে অবস্থার কথা শুনছি, তাতে মনে হচ্ছে জলাবদ্ধতা চরম ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আগামীতে কী হচ্ছে, কী হবে তা কিছুই বুঝছি না। কারণ স্বল্পমেয়াদি কাজ করলেও এক বছর সময় লাগে। কিন্তু এখন তো বর্ষা সামনে চলেই আসছে। জলাবদ্ধতার ভয়, কষ্ট এবং নিরাপত্তাহীনতা এখন থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে। কেননা জলাবদ্ধতায় জীবন, স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন কাজ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম ঝুঁকি থাকে।’চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নগরে ১৬৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটারের ৫৭টি খাল আছে। আছে ১ হাজার ৬০৫ কিলোমিটার ড্রেন। নগরের পানি এসব ড্রেন ও খাল হয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। কিন্তু এখন নগরের ড্রেন ও খালগুলোর অবস্থা চরম বেহাল। খাল, নালা ও ড্রেনগুলো বর্জ্যে ভরাট। জানা যায়, চউক ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটির জন্য ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা অনুমোদন দেয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চসিক চউক চেয়ারম্যান বরাবরে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল খনন চালু রাখার বিষয়ে মতামত প্রদান’ শীর্ষক একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে খাল খনন চসিক করবে নাকি চউক করবে তা জানতে চাওয়া হয়।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, চাক্তাই খালের অবস্থা অত্যন্ত বেহাল। মাস্টারপুল অংশে খনন করা মাটি খালেই পড়ে আছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি প্রবাহ। বিবি মরিয়ম খালটির মরণদশা। দখল ভরাটে ৩০ ফুট প্রস্থের খালটি এখন নালায় রূপ নিয়েছে। বহদ্দারহাট মোড় থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত আরাকান সড়কের দুই পাশে নালা, ডোমখালী খালের বহদ্দারহাট থেকে হামিদচর, মির্জা নয়া খালের বহদ্দারহাট রাজস্ব অফিস থেকে সমশেরপাড়া হয়ে টেকপাড়া, হাজিরপুল থেকে জালিপাড়া খাল, চান্দগাঁও আবাসিক এ এবং বি ব্লক, চন্দ্রিমা আবাসিক, রূপালী আবাসিকসহ বিভিন্ন এলাকার শাখা খাল ও নালা, মরাজরা খালের বাহার সিগনাল থেকে বেপারি পাড়া, কোদালপাড়া বড় খালসহ ৪৬টি খাল ও নালা মাটি-বর্জ্যে বেহালদশা। পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কালিরছড়া খালটি অস্তিত্ব সংকটে। সাড়ে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খালটির অনেক স্থান সরু নালায় পরিণত হয়েছে।