শিরোনাম
শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস আসত বাংলাদেশে

কলকাতা প্রতিনিধি

কলকাতা ও আশপাশের ভাগাড় থেকে সংগৃহীত মরা পশুর মাংস কেবলমাত্র শহরতলি ও শহরতলির রেস্তোরাঁ, হোটেল বা ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই নয়, সীমান্ত পেরিয়ে তা পৌঁছে যেত বাংলাদেশ, নেপালেও। এই চক্রের মূল হোতা সানি মালিককে জেরা করেই উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। বৃহস্পতিবার সানিসহ ছয় অভিযুক্তকে আটক করা হয়। এরপর রাতভর অভিযুক্তদের জেরা করা হয়। তাতেই ভাগাড়ের মরা পশুর মাংসের ব্যবসার সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রের যোগের বিষয়টি জানতে পারে পুলিশ। পুলিশের অনুমান বাংলাদেশ ও নেপালে মাংসের যথেষ্ট চাহিদা থাকার কারণেই ভাগাড়ের এই মাংস রপ্তানি করা হতো ওই দেশগুলোতে। ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস রাসায়নিক সমেত হিমঘরে রাখার পর সেই মাংস প্যাকেটজাত করে বাজারের তুলনায় অনেক কম দামে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেটজাত করার ফলে বিদেশের আমদানিকারকদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে এই মাংস মরা পশুর। পুলিশি জেরায় অভিযুক্তরা কার্যত পুরো ঘটনাটিই স্বীকার করে নিয়েছে বলে খবর।

বাস্তব সত্যিটা হলো মটনের দাম আকাশছোঁয়া। চিকেনও হাত ঠেকালে ছেঁকা খাওয়ার মতো অবস্থা। এমতাবস্থায় দরকার মুখরোচক খাবার। আর সেই পথ দিয়েই বাজারে প্রবেশ করছে ভাগাড়ের মাংস ব্যবসায়ীরা। প্যাকেটবন্দী ভাগাড়ের পচা মাংসই পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতা ও শহরতলির হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে। রাসায়নিকের ব্যবহারে আরও সুস্বাদু সেই মাংস দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে বিরানি বা রোল। বাজার চলতি মটন বা চিকেনের তুলনায় অনেক সস্তায় মিলছে সেই রোল।

তবে ভাগাড়ের মাংসের সবচেয়ে বড় মার্কেট ফ্রোজেন মিট। যে কোনো ডিপার্টমেন্ট স্টোরে দেদার বিকোয় প্যাকেটজাত মিট বল বা সসেজ। নামি-দামি সংস্থার মিট বল বা সসেজের নকল মোড়কে ঢুকছে ভাগাড়ের মাংস। সাধারণ মিট বল বা সসেজের চেয়ে বিশ শতাংশ কমে মিলছে ভাগাড়ের মাংসের এই পণ্য। সস্তায় পেট ভরানোর তাগিদেই তা চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের পেটে। কলকাতা বা শহরতলির ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই সবচেয়ে বেশি নজর ভাগাড় ব্যবসায়ীদের। তবে পুলিশের দাবি এ রাজ্য ছাড়িয়ে বাংলাদেশ বা নেপালের মতো দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে পচা-গলা মাংসের বিশাল ব্যবসা।

কিন্তু যেভাবে ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস প্যাকেটজাত করে সরবরাহ করা হতো-তা সত্যিই অবাক করে দেওয়ার মতো। জানা গেছে, পশুর পচা মাংস ভাগাড় থেকে তুলে আনার চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন না এই ভাগাড় ব্যবসায়ীরা। কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন ভাগাড়ের দায়িত্বে থাকে একজন ইনফরমার। ভাগাড়ে পশুর লাশ পড়লেই সক্রিয় হয়ে যেত চক্রের সদস্যরা। খবর পৌঁছে যেত প্রধান জায়গায়। ভাগাড়ের কাছে হাজির হয়ে যেত গাড়ি। গাড়ির মধ্যেই থাকত রেফ্রিজারেটর। হিমঘরে লাশ পৌঁছানোর পর শুরু হয় প্রক্রিয়াকরণ পর্ব। প্রথমে পশুর লাশ থেকে মাংস ও চর্বিকে আলাদা করে ফেলা হয়। চর্বি ছাড়ার বাকি মাংসে মেশানো হয় সাদা রঙের রাসায়নিক। লাশ সংরক্ষণের জন্য ইঞ্জেকশনও ব্যবহার করা হয়। পরে রাসায়নিক মেশানো পচা মাংসকে ৪-৫ দিন ধরে মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। এরপর সেই প্রসেসড মাংসের সঙ্গে ভালো মাংস মিশিয়ে তা ছোট ছোট প্যাকেটজাত করা হতো। এরপর মিডলম্যানদের হাত ধরে সেই মাংস পৌঁছে যায় এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে। পচা মাংসকেই প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বানানো হয় মিট বল, সসেজ, হাম বা সেলামি। এরপর তা কখনো নামি ব্র্যান্ডের নকল মোড়কে মুড়িয়ে ফেলা হতো। কোনোসময় অনামি কোনো সংস্থার মোড়কেও তা প্যাকেটজাত করা হয়। এরপরই সেই প্রসেসড মাংসই একদিকে চলে যেত কলকাতার বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, ছোট ছোট ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে। অন্যদিকে লিঙ্কম্যানের মাধ্যমে তা চলে যেত বাংলাদেশ, নেপালসহ বিদেশেও। বৃহস্পতিবার রাতেই লিঙ্কম্যান সন্দেহে নদীয়া জেলার কল্যাণী থেকে আটক করা হয় এক অভিযুক্তকে।

তাকেও দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পর এই চক্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসাজশের বিষয়টিতে আরও নিশ্চিত হয়েছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এই চক্রের পিছনে আরও কোন মাথা রয়েছে তাদের খোঁজে একাধিক জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

উল্লেখ্য, গত ১৯ এপ্রিল মরা পশুর মাংস বাজারে সরবরাহের অভিযোগটি প্রথম আসে। ওই ঘটনায় দুজনকে আটক করার পরই এই চক্রের হদিস পায় পুলিশ। এরপর অভিযান চালিয়ে কলকাতার নারকেলডাঙ্গা এলাকায় হিন্দুস্তান আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোর (হিমঘর)-এর সন্ধান পায়। সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রায় বিশ টন ওজনের এক হাজারটি প্যাকেটজাত মাংস উদ্ধার করা হয়েছে যার সবটাই মরা পশুর মাংস বলে জানা গেছে। যেগুলো কলকাতাসহ পার্শ্ববর্তী হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত ছিল। মাংস উদ্ধারের পর ওই হিমঘরটিকে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওই মাংস পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ল্যাবরেটরিতে। 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর