শিরোনাম
শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইউটার্ন-রাইট টার্নেই যানজট

লাখ লাখ টাকায় দফারফা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে

সাঈদুর রহমান রিমন

রাজধানীর অতিব্যস্ত রাস্তায় ‘অবৈধ ইউটার্নের’ ছড়াছড়িতেই বাধে যানজট, অহরহ ঘটে দুর্ঘটনা। ট্রাফিক বিভাগের কাছেও এসব ইউটার্ন-রাইট টার্ন যানজট-দুর্ঘটনার প্রধান নিয়ামক হিসেবেই চিহ্নিত। কিন্তু প্রতিটি ইউটার্নের বিপরীতে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা মিলে বলেই ট্রাফিক বিভাগ কর্তৃক অবৈধ ইউটার্নগুলো জিইয়ে রাখার অভিযোগ উঠেছে। তবে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর ইউটার্ন পয়েন্ট থেকে ট্রাফিক রাজধানীর মগবাজার পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়কে আটটি এবং মালিবাগ রেলগেট থেকে প্রগতি সরণির কুড়িল পর্যন্ত ৯টি ইউটার্ন-রাইট টার্ন নগর পরিবহনের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব স্থানে বাস-মিনিবাসগুলো নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ঘুরানোসহ উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে। বিশালাকার বাসের ইউটার্নের কারণেই প্রতিনিয়ত এসব পয়েন্টে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। তাছাড়া বেপরোয়া গতির গাড়িগুলোও বিপজ্জনকভাবে এসব ইউটার্নে ঘোরানো কালেই ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটায়। গত এক মাসে এ দুটি রোডের ১৭টি ইউটার্নস্থলেই কমবেশি ৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ পথচারীর। আহত হচ্ছেন শত শত ব্যক্তি। এর মধ্যে বিমানবন্দর গোলচত্বর, জসিমউদ্দিন রোড মোড়, হাউস বিল্ডিং ক্রসিং ও আব্দুল্লাহপুরের সবচেয়ে ব্যস্ততম ইউটার্নেই সর্বোচ্চ সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।

নিষেধ থাকা সত্ত্বেও উত্তরা আব্দুল্লাহপুরের ব্যস্ত ক্রসিংটিতে প্রতিদিন অন্তত ২৫টি পরিবহন কোম্পানির চার শতাধিক বাস-মিনিবাস অবৈধভাবে রাইট টার্নে ঘুরে ফিরে। ফলে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে ভয়াবহ যানজট লেগেই থাকে। অবৈধ রাইট টার্নের সুবিধা নেওয়ার বিপরীতে পরিবহন কোম্পানিগুলো প্রতি মাসে সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক কর্মকর্তাকে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আব্দুল্লাহপুর পেরিয়েই উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার ৩২ রুটে এবং গাজীপুর-ময়মনসিংহের ছয় জেলার ২২ রুটে কয়েক হাজার কোচ-মিনিবাস চলাচল করে থাকে। কিন্তু অবৈধ ইউটার্নটি পেরিয়ে যেতেই এক দেড় ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়।

নর্দা, নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, মেরুল বাড্ডা, হাতিরঝিল পয়েন্টে ইউটার্ন রয়েছে। প্রতিটি ইউটার্নই যানজট সৃষ্টির মোড় হিসেবেই বেশি পরিচিত। এসব ইউটার্ন পয়েন্টে সর্বোচ্চ পরিমাণে যাত্রী ভোগান্তি ঘটে। যানজটের দোহাই দিয়ে ট্রাফিক বিভাগ প্রগতি সরণির নতুনবাজার ক্রসিং বন্ধ করার পর ২০০ গজের মধ্যে নতুন তিনটি ক্রসিং তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ক্রসিংয়েই অবৈধভাবে রাইটটার্ন করেই চলাচল করছে শত শত বাস-মিনিবাস, প্রাইভেটকার। পাশাপাশি তিনটি ক্রসিংয়ের কারণে এখন এক কিলোমিটারব্যাপী যানজট প্রায় লেগেই থাকছে। এদিকে পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফুট সড়কে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশমুখের ইউটার্নটি যখন তখন বন্ধ করায় আরেক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে যখন তখন ইউটার্ন পয়েন্টে ট্রাফিক সাইন দিয়ে আটকে দেওয়া হয় এবং গাড়িগুলোকে আরও দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকের একটি পয়েন্ট দিয়ে ঘুরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু গাড়ি ঘোরানোর ওই পয়েন্টে কোনো ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন না থাকায় প্রায়ই সেখানে দুর্ঘটনা ঘটে, যানজটও বাধে। ইউটার্নের আধিক্য থাকা কয়েকটি রোড সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দেড়-দুইশ’ মিটার পর পরই একটি করে ইউটার্নের ব্যবস্থা আছে, আর পথচারী পারাপার হচ্ছে যত্রতত্র। অথচ ইউটার্নের আগে বা পথচারী পারাপারের জন্য কোথাও কোনো রোড সাইন পর্যন্ত নেই। ফলে বাম লেন দিয়ে চলতে চলতেই গাড়িগুলো ইউটার্নের জন্য হঠাৎ থেমে যায় এবং ডানপাশে মোড় নেওয়ার প্রক্রিয়া চালায়। এই থেমে যাওয়া ও ডানে ঘোরার প্রক্রিয়াতেই পেছনে শত শত গাড়ি আটকে পড়ে, সৃষ্টি হয় যানজটের। একইভাবে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে শহীদ ফারুক সড়ক এবং জুরাইন সড়ক থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত নির্ধারিত ‘ইউটার্ন’ ব্যবহারের পরিবর্তে সহজে যাত্রাবাড়ী মোড় দিয়ে রাস্তা ক্রসিংয়ের কারণে প্রায়ই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবলরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী যাত্রাবাড়ী গোলচত্বর ক্রস না করে সায়েদাবাদ ব্রিজ হয়ে যানবাহন ঘুরে আসার কথা। কিন্তু যাত্রী ও মাল বোঝাই গাড়িগুলো সহজে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাওয়ার জন্য গোল চত্বর দিয়েই সরাসরি পারাপার হয়। অপরদিকে ডেমরা সড়কে চলাচলকারী যানবাহনও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা অতিক্রমের জন্য কোনো নিয়ম মানছে না বলেই সেখানে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

দারুস সালাম, কল্যাণপুর ও শ্যামলী শিশুমেলা ক্রসিংয়ে তিন জায়গাতেই আছে ইউটার্ন। অন্য পাশের সড়কে যানবাহনের চাপ থাকায় এসব ইউটার্নে যানবাহন ঘোরাতে গেলেই দীর্ঘ যানজটের সূত্রপাত ঘটে। পেছনে আটকা পড়ে গাবতলী, মিরপুর থেকে আসা গাড়িগুলো। ফলে দিনের বেশির ভাগ সময় টেকনিক্যাল মোড় থেকে কলেজগেট পর্যন্ত সড়কের এক পাশে তীব্র যানজট লেগেই থাকছে।

 এসব ইউটার্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং আর সড়কের দুই পাশে থাকা ফিলিং স্টেশনে জ্বালানি নিতে আসা যানবাহনের সারি। গাবতলী, মিরপুর-১ নম্বর, টোলারবাগ, আনসার ক্যাম্প, কল্যাণপুর আশপাশ এলাকার যাতায়াত করা যাত্রীরা এখানকার যানজটে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার। এ তিন ইউটার্নের কারণে কল্যাণপুর, শ্যামলী বাসস্ট্যান্ড ও কলেজ গেট এলাকায় রাত-দিন যানবাহন কেন্দি ক নানা বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে।

এসব ব্যাপারে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, যত্রতত্র রাস্তা কেটে ইউটার্ন বানিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে সীমাহীন জটিলতর করে তোলা হয়। রাজধানীর পরিকল্পিত ইউটার্নগুলোতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা ঠিকই রয়েছে, কিন্তু শত শত ইউটার্ন পয়েন্টে জনবল মোতায়েন করা তো সম্ভব হয় না।

ইউটার্নজনিত কারণে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রতিটি সড়ক-মহাসড়কেও বেহাল পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে। ঢাকা-গাজীপুর সড়কের আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত অন্তত ১৮টি ইউটার্ন রয়েছে। মাত্র ১৫ কিলোমিটারের এই দূরত্বে এতগুলো ইউটার্ন যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে। দুপুরের পর থেকে ইউটার্নগুলোয় বাস, ট্রাক, লরি, প্রাইভেটকার থেকে শুরম্ন করে রিকশা সবই দুই পাশের রাসত্মা বন্ধ করে পার হয়। যে কারণে টঙ্গী স্টেশন রোড, চেরাগআলী, টঙ্গী কলেজ গেটে তীব্র যানজট হয় প্রতিদিন। সড়কজুড়ে উল্টোমুখী যান চলাচল করছে অবলীলায়। টঙ্গীর এ যানজটের ধকল রাজধানীর উত্তরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

ডিএনসিসির ১১ ইউটার্ন নির্মাণ আটকে আছে : যানজট কমাতে তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে উত্তরা-আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পটি এখন মাটি খোঁড়াখুঁড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ইউটার্ন না থাকায় এ পথে গাড়ির একবার জ্যাম লাগলে পুরো সড়ক অল্প সময়ের মধ্যে যানবাহনে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এসব বিবেচনায় নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১১টি পরিকল্পিত ইউটার্ন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০১৬ সালে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে উত্তরা হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণের এবং বাকি সব অবৈধ ইউটার্ন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। জানা গেছে, ইউটার্নের জন্য প্রাথমিকভাবে সওজ, রেলওয়ে ও ভূমি অফিসের জায়গা ব্যবহারের অনুমোদনও পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তশানে সংস্থাগুলো তাদের জায়গা ব্যবহারের ব্যাপারে চূড়ান্ত অনুমোদন দিচ্ছে না। ফলে ডিএনসিসির এই প্রকল্পের কাজ থমকে আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর