রেল লাইনে প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে, মিলছে লাশ। এ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেলে না রিপোর্ট। ফলে জানা যায় না মৃত্যুর আসল কারণ। আবার কিছু ক্ষেত্রে রিপোর্ট পাওয়া গেলে দেখা যায়, লাশে রয়েছে অন্য রহস্য। মৃত্যুর ধরন দেখে দুর্ঘটনা মনে হলেও দেখা যায়- এ লাশ ছিনতাইকারীরা ফেলেছে, অথবা হত্যাকাণ্ড চাপা দিতে লাশ এনে রেল লাইনে ফেলে দুর্ঘটনা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একটি ঘটনা গত ২৪ ফেব্রুয়ারির। বিমানবন্দর রেল স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে লাগেজের ভিতর থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। লাশটি ছিল পল্লবীর শহীদ জিয়া মহিলা ডিগ্রী কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আঁখি আকতারের (১৬)। প্রথম থেকেই পুলিশের সন্দেহে এটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত ছিল। পরে জানা যায়, রাজধানীর পল্লবীতে ধর্ষণের পর খুন করা হয় তাকে। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ৮ ঘণ্টা ব্যবধানে একই স্টেশন থেকে সাকিব খান (২৫) নামে এক যুবকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, তিনি আগারগাঁয়ের কৃষি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। পুলিশ ধারণা করে- ট্রেনের ছাদে দাঁড়ানো অবস্থায় স্টেশনের ছাউনিতে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যু হয়েছে সাকিবের। কিন্তু ময়না তদন্তের রিপোর্টের পর পাল্টে যায় হিসাব-নিকাশ। বেরিয়ে আসে ওই যুবকের মৃত্যুর অন্য রহস্য। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনা ছাড়াও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো অন্যত্র ঘটে। পরে লাশ রেল লাইনের ওপর ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা, যাতে মানুষ মনে করে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয়েছে।

ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে থানা পুলিশের হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছর শুধু জানুয়ারিতেই রেল লাইন থেকে ৪৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত বছরে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব লাশের মধ্যে পুরুষের ২৫২টি এবং নারীর ৯২টি। দু-একটি ছাড়া অধিকাংশই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পায়নি পুলিশ। 

এক পর্যায়ে এরা সাকিবকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। এতে গুরুতর আহত হয়ে সাকিব জ্ঞান হারান। ছিনতাইকারীরা তখন তার কাছে থাকা মোবাইল ও ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে টঙ্গি রেল স্টেশনে নেমে পড়ে। জানা গেছে, এ খুনের শুভ ছাড়া বাকিরা এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছে। 

ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন ফারুক মজুমদার এ প্রতিবেদককে জানান, রেল কিংবা লাইনে আগের চেয়ে অপরাধমূলক কাজ কমে গেছে। এরপরও কিছু ঘটনা ঘটলে স্বল্প লোকবল নিয়ে তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। 

দুই কিশোরের লাশে রহস্য : গত বছরের ২৩ মার্চ নীলফামারির ডোমার উপজেলার জোড়াবাড়ি ইউনিয়নের চিলাহাটি রেলপথের মির্জাগঞ্জ রেলস্টেশনের এক কিলোমিটার দূরে মাঝাপাড়া ও সওদাগরপাড়া এলাকা থেকে দুই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। তাদের মুখে কালি মাখানো ও শরীরের পেছনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এ ঘটনারও পুরো রহস্য এখনো অজানায় রয়ে গেছে। 

রহস্য অজ্ঞাত যুবকের লাশে : ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিমানবন্দর স্টেশন পেরিয়ে টঙ্গির কাছে রেল লাইনের পাশ থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছিল রেলওয়ে থানা পুলিশ। এ ব্যাপারে প্রথমে দুর্ঘটনা হিসেবে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল পুলিশ। কিন্তু নিহতের স্বজনরা যুবককে শনাক্ত করলে তদন্তের মোড় ঘুরে যায়। এরপর পুলিশ তদন্তে জানা যায়- এটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। লাশটি যশোরের বাসিন্দা আবু বকরের। তিনি ঢাকা কমলাপুর থেকে চিত্রা ট্রেনের ছাদে উঠে বাড়ি ফিরছিলেন। ওই ছাদেই তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলেই আবু বকরের মৃত্যু হয়। তার আগে গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় রেল লাইনের পাশ থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ বছর বয়সী ওই অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে অপমৃত্যু মামলা হয়। পরবর্তীতে এ মামলাও হত্যা মামলায় টার্ন নেয়। 

লাশ রহস্য : ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানান, রেল লাইন থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ লাশের অবস্থা এমন হয়ে যায়, সেখান থেকে খুনের আলামত সংক্রান্ত কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় না। এ জন্য দুর্বৃত্তরা কাউকে অচেতন করে রেল লাইনে ফেলে রেখে হত্যা করতে পারে। আর পুলিশ ভিসেরা পরীক্ষার আবেদন না করায় নিহতদের ভিসেরা সংরক্ষণ করে অচেতনের বিষয়টিও পরীক্ষা করা হয় না। মৃত্যুর কারণ নিয়ে সন্দেহ হলে অনেক চিকিৎসক আবার ‘হত্যা’ ‘আত্মহত্যা’ কিংবা ‘দুর্ঘটনাজনিত’- এসব কিছুই উল্লেখ করেন না।