রবিবার, ১৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

সাইফ হত্যা নিয়ে থমথমে শিবগঞ্জ পুলিশ মোতায়েন, গ্রেফতার ৮

কাজী শাহেদ, মর্দানা থেকে ফিরে

স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সাইফুদ্দিন (৪৮)। আর বাড়ি ফিরে আসতে পারেননি। ঘরে ফিরেছে তার নিথর দেহ। দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ স্ত্রী পারুল বেগমকে ভাসিয়েছেন অকূল পাথারে। গত মঙ্গলবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দানা-আইয়ুব বাজার এলাকায় নৃশংসভাবে খুন হন সাইফুদ্দিন। বুধবার তার দাফন হয়েছে। এখনো শুকায়নি রক্তের দাগ। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নৃশংসতার ছাপ। এখনো থমথমে পুরো এলাকা। সাইফ হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। প্রধান আসামি পৌর কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেম পলাতক।

বৃহস্পতিবার দুপুরে যেখানে খুন হন সাইফ, সেখানে এসে নীরবে চোখের জল ফেলছিলেন স্ত্রী পারুল বেগম। ঘটনার পর থেকেই ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন আছে। তবুও উৎকণ্ঠায় পুরো এলাকার মানুষ। এলাকাবাসীর ভাষ্য, পুলিশ না থাকলে সন্তানদের নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেই পারতেন না পারুল।

হত্যাকান্ডের স্থান দেখিয়ে পারুল বলেন, ‘এখানেই আমার স্বামীকে একদল সন্ত্রাসী কুপিয়েছে। পরে আমাদের বাড়িতে এসে গরু-বাছুরসহ জিনিসপত্র লুটে নিয়ে গেছে।’ এরপর আর কথা বাড়াতে পারেননি পারুল।

বসতবাড়ি ছাড়া সম্বল বলতে এক বিঘা ধানি জমি। বড় ছেলে ইনজামুলকে (২৩) নিয়ে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন সাইফুদ্দিন। মাঝেমধ্যে অন্যের জমি বর্গাচাষ করতেন। একমাত্র মেয়ে সানজিদা খাতুন (২০) রানীহাটি ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে পারভেজ (১৮) এসএসসি পাস করে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করেন। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনাসহ সংসার চলত সাইফুদ্দিনের একার আয়ে। স্বামীকে হারিয়ে কীভাবে বাকি পথ পাড়ি       দেবেন সেই দুশ্চিন্তায় পারুল বেগম। সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন সাইফুদ্দিন। পাশের বাড়ির দরজার ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন তার বড় ভাই মুকুল হোসেন (৫৬)। ভাইয়ের ওপর চতুর্মুখী হামলার খবর পেয়ে তিনি তাকে রক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশীরা তাকে জোর করে বাড়িতে ঢুকিয়ে নেন। মুকুল হোসেন বলেন, এর আগে একই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন তার আরেক ভাই তাইফুর রহমান। চোখের সামনে আরেক ভাই সাইফুদ্দিনকে নৃশংসভাবে কোপাতে দেখেছেন। কিন্তু ভাইকে বাঁচাতে পারেননি। প্রতিবেশীরা তাকে আসতেই দেননি। তিনিও সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে পড়বেন এই শঙ্কায় প্রতিবেশীরাই তাকে আটকে রাখেন। ওই সময় তার বাড়ি, তার আরও ভাই-ভাতিজাদের বাড়িতেও হামলা ও লুটপাট হয়। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ এলে তিনি বেরিয়ে আসেন। মুকুল হোসেনের দাবি, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের নির্দেশেই এ হামলা হয়েছে। পরে এ নিয়ে জেমসহ ৩৪ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি। এর আগেও সাইফুদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে কয়েক দফা হামলা চালায় জেমের অনুসারীরা।

 কিন্তু বরাবরই প্রাণে বেঁচে যান সাইফুদ্দিন। সন্ত্রাসীদের তা-ব চলাকালে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসেন আয়েশা বেগম। ছুটে যান ভাইয়ের কাছে।

তার ভাষ্য, ভাইকে রক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার পর তার গলায় ধারালো অস্ত্র ঠেকায় সন্ত্রাসীরা। শুধু নারী হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। ওই সময় পরিবারের যে পুরুষ সদস্য আসত, তাকেই হত্যা করত হামলাকারীরা।

আয়েশা বেগম জানান, তার ভাইয়ের পুরো শরীর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয় সন্ত্রাসীরা। দুই পা ও দুই হাতের রগ কেটে দেয়। ওই সময় মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তার ভাই। সন্ত্রাসীরা দূরে সরতেই পাশের টিউবওয়েল থেকে পানি আনেন তিনি। পানি মুখে তুলে দেওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা আবারও ফিরে আসে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে উল্লাস করতে থাকে। আয়েশার অভিযোগ, ঘটনার এক ঘণ্টার বেশি সময় পর পুলিশ এসেছে। আরও আগে পুলিশ এলে ভাইকে হয়তো বাঁচানো যেত।

একেবারেই প্রান্তিক কৃষক ছিলেন সাইফুদ্দিন। তবে কেন এমন নৃশংসতার শিকার তিনি-এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী জানান, গ্রামীণ রাজনীতির বলি সাইফ। তিনি ও তার পুরো পরিবার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সালামের সমর্থক ছিলেন। আর এ কারণেই বর্তমান কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের রোষানলে পড়ে পরিবারটি।

কেবল এই পরিবারই নয়, যারা কাউন্সিলর জেমের বিরোধিতা করেন তাদেরই সাইফুদ্দিনের মতো পরিণতি বরণ করতে হয়। গত ৫ বছরে এলাকায় অন্তত ৫টি হত্যাকা- ঘটেছে। এর প্রতিটিতেই কোনো না কোনোভাবে কাউন্সিলর জেমের হাত আছে। প্রতিপক্ষকে দমাতে বরাবরই নৃশংসতা বেছে নিয়েছেন জেম।

এলাকাবাসী আরও জানান, প্রতিবারই হত্যাকান্ডের পর এলাকায় পুলিশ অবস্থান করে। ওই সময় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ সরে যাওয়ার পরই আবারও নিজেদের অবস্থান পাকা করে কাউন্সিলর জেমের বাহিনী। সুযোগ পেলেই এলাকাবাসীর ওপর চলে নৃশংসতা। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চান না।

ঘটনার পর থেকে মর্দানা-আইয়ুব বাজার এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন শিবগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছে। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এলাকায় আসছেন। পরিস্থিতি এখন শান্ত। লোকজন নির্ভয়ে বাইরে বেরোচ্ছেন। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে কয়েকদফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে এ নিয়ে তার মন্তব্য মেলেনি। এলাকাবাসী বলছেন, এ ঘটনার পর থেকে খাইরুল আলম জেমকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।

তদন্ত কর্মকর্তা ও শিবগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান বলেন, কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেম এবং পলাতক অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, শিবগঞ্জে যে হত্যাকা- ঘটেছে সেটি একেবারেই আলাদা। ককটেল ফুটিয়ে পরে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় আটজন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর