রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

অবৈধ বাল্কহেডের কারণে ঝুঁকিতে বন্দর চ্যানেল

মোহনায় দুর্ঘটনায় পড়লে বিঘ্নিত হতে পারে বন্দরের কার্যক্রম

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বর্তমান সময়ে নৌপথে পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাহনের নাম বাল্কহেড। স্থানীয়ভাবে ‘ভলগেট’ হিসেবে পরিচিত এসব নৌযানে পণ্য বোঝাই করলে পুরো যানটি পানিতে প্রায় ডুবে যায়। ওই অবস্থায় নৌযানটি যাত্রা করে গন্তব্যে। মৌসুমি বায়ু কিংবা সামান্য ঝোড়ো হাওয়াতেই এ নৌযানটি ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে সব সময়। বর্তমানে লাইটার জাহাজের বিকল্প হিসেবে পণ্যবাহী এ ধরনের ২ শতাধিক অবৈধ বাল্কহেড ঝুঁকিতে ফেলছে বন্দর চ্যানেলকে। পাথর ও বালু বোঝাই এসব বাল্কহেড চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল ও কর্ণফুলী নদীতে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সর্বশেষ ৩ মার্চ কর্ণফুলীর কালারপুলে একটি পাথরবাহী বাল্কহেড ডুবে যায়। এতে দুজন শ্রমিক নিখোঁজ হন। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ বাল্কহেড দিয়েই বহির্নোঙর হতে মাদার ভেসেল থেকে কয়লা, পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য খালাস করে শিপ হ্যান্ডলিংয়ে জড়িত একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। আবার অবৈধ বাল্কহেডের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে শুধু জরিমানা করেই দায় সারছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, বাল্কহেডকে লাইটারেজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বন্দর চ্যানেলকে নিরাপদ করতে এসব বাল্কহেডের চলাচল রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী নদী ঘিরে বালু ব্যবসায়ীরা মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলা থেকে অবৈধ বাল্কহেড সংগ্রহ করে বালু বোঝাই ও পরিবহন করে আসছেন। কর্ণফুলী নদী থেকে বালু বোঝাই করে এসব বাল্কহেড শিকলবাহা খাল, ভেল্লাপাড়া, মুরালী খাল, সাঙ্গু নদ, চানখালী খাল, মিলিটারিপুল এলাকায় বালু বহন করে। দীর্ঘদিন ধরে এসব বাল্কহেডকে পণ্য লাইটারিংয়ের কাজেও ব্যবহার করছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ধরনের কারিগরি নকশা ছাড়াই মিস্ত্রি ও ওয়েল্ডারের পরিকল্পনায় এসব বাল্কহেড নির্মাণ করা হচ্ছে। যারা এ নৌযান তৈরির সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই। নির্মাণকারী ডকইয়ার্ডগুলোরও নেই কোনো বৈধ অনুমতির কাগজপত্র। এমনকি এসব নৌযানের কোনো হুইল থাকে না। শিপ হ্যান্ডলিংয়ে জড়িত একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিংয়ের জন্য অবৈধ বাল্কহেড ব্যবহার করে আসছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে এসব সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও রোধ করতে পারেননি বাল্কহেডের ব্যবহার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন অবৈধ এসব বাল্কহেড কয়লা, পাথরসহ কার্গোপণ্য বোঝাই করে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করছে। বিশেষ করে পাথর নিয়ে রাজবাড়ী, মিরসরাই, কুতুবদিয়া, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করে এসব বাল্কহেড। আবার বন্দরের অভ্যন্তরীণ সদরঘাট, মাঝিরঘাট, শাহমীলপুর ঘাটসহ বিভিন্ন ঘাটে বালু ও পাথর খালাস করে। এদিকে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর সিন্ডিকেটটির সঙ্গে যোগসাজশে চট্টগ্রামে বাল্কহেড সরবরাহ করেন চাঁদ মিয়া নামে এক ব্রোকার। এ বিষয়ে ডব্লিউটিসির লোকাল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক নুরুল হক বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই অবৈধ বাল্কহেডগুলো পণ্য নিয়ে চলাচল করছে। এখন বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে পাথর ও কয়লা খালাস নিয়ে বাল্কহেডগুলো রাতের বেলায় যাচ্ছে।

 বাল্কহেডগুলো যখন পণ্য লোড নেয় তখন দূর থেকে দেখা যায় না। মানুষ যেভাবে ডুব মেরে শুধু নাক ভাসিয়ে নিঃশ্বাস নেয়, সেভাবে পুরো খোলস পানির মধ্যে ডুবে যায়, শুধু পেছনে ইঞ্জিন রুমের কিছু অংশ ও সামনের কিছু অংশ দেখা যায়।’ তিনি বলেন, ‘বাল্কহেডগুলো খুবই দুর্ঘটনাপ্রবণ। একটু জোরে বাতাস এলেই ডুবে যায়। চ্যানেলে কোনো দুর্ঘটনায় বাল্কহেড ডুবে গেলে বন্দরে ফিডার জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমনকি বন্দরের পুরো কার্যক্রমও হতে পারে ব্যাহত। প্রতি রাতে ৪০-৫০টি বাল্কহেড লোড হয়। সব মিলিয়ে দুই শর অধিক অবৈধ বাল্কহেড বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উপ-সংরক্ষক ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম বলেন, ‘দুই বছর ধরে বাল্কহেড দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। সে জন্য বহির্নোঙরে বাল্কহেড চলাচল বন্ধে আমরা কোস্টাল মালিক অ্যাসোসিয়েশন, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল, নৌপরিবহন অধিদফতর, নৌবাণিজ্য অধিদফতর সবাইকে নিয়ে দফায় দফায় মিটিং করেছি। ওই সব বৈঠকে সিদ্ধান্ত ছিল ডিজি শিপিং (নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক) বাল্কহেডগুলোকে পণ্য পরিবহনের জন্য অনুমোদন করবেন না। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল ও ইনল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট মালিকরা বহির্নোঙরের মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিংয়ের কাজে বাল্কহেড ব্যবহার করবেন না। এ বিষয়ে বন্দরের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। এর পরও তা উপেক্ষা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বাল্কহেড চলাচল বন্ধের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের দুটি কার্যক্রম চালু রয়েছে। নিরাপদ নৌ চলাচলের জন্য আমাদের একটি নদীটহল জাহাজ আছে। ওই জাহাজে করে টহল দেওয়া হয়। আবার বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযানও চালানো হয়। এ পর্যন্ত ২০টির মতো বাল্কহেডকে জরিমানা করেছি।’ তবে ‘বাংলাবাজার থেকে শাহ আমানত সেতুর দিকে বাল্কহেড চলাচল করতে পারে’ এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কর্ণফুলী নদীতেও নজরদারি বাড়াব। বাল্কহেড চলাচল বন্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর