শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পরিস্থিতি অবনতির ধাপে বাংলাদেশ

ইউপি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগে অন্তর্দ্বন্দ্ব, নির্বাচনে হতাহত, জঙ্গি আটক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, রোহিঙ্গা শিবির পরিস্থিতিও স্থান পেয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতায় আবারও ‘অবনতিশীল পরিস্থিতি’র মানচিত্রে ফিরেছে বাংলাদেশ। সংকট বিশ্লেষণকারী ব্রাসেলসভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) এ পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে। এবারের প্রতিবেদনে ইউপি নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। গত অক্টোবরেও একবার দুর্গাপূজার সময় গুজব, সংঘাত ও প্রাণহানির জন্য বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে অবনতিশীল বলে উল্লেখ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এবার গত নভেম্বরজুড়ে নির্বাচনী সংঘাতে হতাহত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে আবার বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে অবনতিশীল তালিকায় রেখেছে আইসিজি। এর আগে আইসিজি ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার কারণে বাংলাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতির তথ্য তাদের বিশ্লেষণে তুলে ধরেছিল। ঢাকায় গত সপ্তাহে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের উদ্দেশে সরকারের ব্রিফিংয়ে ইউপি নির্বাচন ঘিরে সংঘাত ও মৃত্যুর বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন পরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলগুলোর অনেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে। উচ্ছ্বাস বেশি। একমাত্র খারাপ বিষয় হলো মৃত্যু। কোনো নির্বাচনেই আমরা একটি মৃত্যুও চাই না। তবে আমি জানি না এটি কীভাবে সম্ভব।’ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে নির্বাচনী সহিংসতাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচনে সহিংসতাগুলোর বেশির ভাগই হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।

আইসিজি তাদের প্রতিবেদনে গত নভেম্বরের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে ৪৫ জনেরও বেশি নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধে বেশ কয়েকজন নিহত হন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ওই নির্বাচন বর্জন করেছে (বস্তুত বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছেন)। নরসিংদীতে গত ৪ নভেম্বর সংঘর্ষে তিনজন নিহত এবং ১০ জন আহত হন। গত ৫ নভেম্বর কক্সবাজারে সংঘর্ষে নিহত হন একজন। পাবনা ও মেহেরপুরে গত ৮ নভেম্বর সংঘর্ষে দুজন নিহত এবং ৩৫ জন আহত হন। ভোটের দিন নরসিংদী, কুমিল্লা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় সংঘর্ষে অন্তত সাতজন নিহত হন। সেদিন দেশজুড়ে নির্বাচনী সহিংসতায় শতাধিক লোক আহত হন। ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে গত ২৫ থেকে ২৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভোলা ও টাঙ্গাইল জেলায় আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে অন্তত তিনজন নিহত হন।  ভোটের দিন টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, খুলনা, যশোর, ঠাকুরগাঁও ও মুন্সীগঞ্জে সংঘাতে বেশ কয়েকজন নিহত হন। চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আগামী ২৬ ডিসেম্বর এবং পঞ্চম ধাপের নির্বাচন আগামী বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নভেম্বর মাসজুড়েই কথিত জঙ্গি গ্রেফতার অব্যাহত ছিল।

কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকে জামা’আতুল মুজাহিদীনের একজন সদস্য ও দিনাজপুর থেকে আনসার আল ইসলামের একজন সদস্যকে আটক করে। সরকার তার সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা অব্যাহত রেখেছে বলেও ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, ওই আইনের আওতায় কর্তৃপক্ষ গত ২ নভেম্বর দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এবং গত ৮ নভেম্বর তিনটি মামলায় ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়ার দাবিতে বিএনপি গত ২৪ নভেম্বর আট দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেয়। পুলিশ গত ৩ নভেম্বর কক্সবাজারের একটি শিবিরে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির কথিত এক নেতার মরদেহ উদ্ধার করেছে। পুলিশ বলেছে, জনতার পিটুনিতে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গত ৮ নভেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে অবৈধ অস্ত্র কারখানার সন্ধান পেয়েছে বলে দাবি করেছে এবং তিনজন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। এদিকে জাতিসংঘ গত মাসে ভাসানচরে দ্বিতীয়বার সফর করেছে। ছয় মাস বিরতির পর গত ২৫ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে সপ্তম দফায় এক হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। আইসিজি বিশ্বব্যাপী সংঘাত, সহিংসতার তথ্য তুলে ধরে পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে। আইসিজির এসব বিশ্লেষণ কৌশলগত তথ্য হিসেবে বিভিন্ন দেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান ও গবেষকরা ব্যবহার করেন।

সর্বশেষ খবর