শুক্রবার, ৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
আউটসোর্সিংয়ে কর্মচারী নিয়োগ

রেল কর্তৃপক্ষ ও কর্মীরা মুখোমুখি

অব্যাহতি হিসাব বিভাগে, আন্দোলন পুরো রেলে

সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

রেল কর্তৃপক্ষ ও কর্মীরা মুখোমুখি

বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব বিভাগের ১০০ জন টেম্পরারি লেবার রিক্রুটমেন্ট (টিএলআর) পদ্ধতিতে অস্থায়ী কর্মচারীকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে অব্যাহতির বিষয়কে ঘিরে সারা দেশের পুরো রেল অঙ্গনে শুরু হয়েছে শ্রমিক সংগঠনসহ কর্মচারীদের নানা অস্থিরতা। এই নির্দেশনা শুধু রেলওয়ের অর্থ বিভাগে হলেও এর প্রভাব পড়েছে সংস্থাটির প্রতিটি বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে। এটিকে কেন্দ্র করে শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি সাধারণ কর্মীরাও আন্দোলনে নেমেছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন রেলস্টেশনে বিক্ষোভ ও সমাবেশও করেছেন তারা। অন্যদিকে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকে টিএলআরদের অব্যাহতি দিয়ে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে। এ জন্য রেলের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কোনো দায় নেই। তবে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান না হলে কর্মচারীরা আরও কঠোর হতে পারেন বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। রেলওয়ে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে (কাজ নাই মজুরি নাই বা কানামনা পদ্ধতি) রেলওয়ের বিভিন্ন দফতরে কাজ করেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অস্থায়ী কর্মচারী। এই পদ্ধতি থেকে সরে এসে আউটসোর্সিংয়ে নিম্নশ্রেণির লোকবল নিয়োগ দিতে চাইছে সংস্থাটি। এ লক্ষ্যে চলতি অর্থবছর থেকে রেলের হিসাব বিভাগের এমন ১০০ জন কর্মচারীকে অব্যাহতি দেওয়ায় তৈরি হয়েছে জটিলতা। ৩০ জুন এক চিঠিতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল হিসাব বিভাগ ‘কাজ নাই, মজুরি নাই- কানামনা’ ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৬ থেকে ২০তম গ্রেডের শ্রমিকদের অব্যাহতি দেয়। চলতি বছর ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত পরিচালন বাজেট সমন্বয় সভায় অস্থায়ী রেলওয়ের কর্মচারীদের ২০২১-২২ অর্থবছরে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত ছিল, ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে রেলে কর্মরত অস্থায়ী কর্মীদের ব্যয় অফিসভিত্তিক কোডের (শ্রমিক অনিয়মিত মজুরি) পরিবর্তে আউটসোর্সিং খাত থেকে ব্যয় করা হবে। ৩০ মে রেলের মহাপরিচালকের কার্যালয়ের এক চিঠিতেও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

 এ লক্ষ্যে পূর্বাঞ্চলের হিসাব বিভাগ থেকেই অস্থায়ী কর্মচারীদের অব্যাহতি কার্যক্রম শুরু হয়। এ ঘোষণার পর থেকে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের শ্রমিক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে আন্দোলনে।

আরও জানা গেছে, সরকার টিএলআর নিয়োগ পদ্ধতিতে নানা অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সুশৃঙ্খল জনবল কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। নতুন নিয়োগবিধি সংশোধনের প্রক্রিয়ায় থাকায় আপাতত চাহিদা অনুসারে লোকবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে টিএলআর নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যমান টিএলআরদের মধ্য থেকেই আউটসোর্সিংয়ে লোকবল নেওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন দফতরে পুরনো ও দক্ষ টিএলআর কর্মীদের বাদ দেওয়া হলে ট্রেন অপারেশন বিঘিœত হওয়ার ঝুঁকি থাকায় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে খাতওয়ারি আউটসোর্সিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে ১৩ জুন রেল সচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক ডি এন মজুমদার। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মিত শ্রমিক নিয়োজনের মাধ্যমে মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেলওয়েতে ৪ হাজার ৮৯৬ জন অস্থায়ী কর্মী কাজ করছেন। এ খাতে বছরে খরচ হয় ৬০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৬ হাজার অস্থায়ী কর্মী প্রয়োজন হবে। বাড়তি কর্মীসহ খাতটিতে রেলের ব্যয় হবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। এসব বিবেচনায় টিএলআর নিয়োগের পরিবর্তে আউটসোর্সিংয়ের বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় অনুরোধ জানান তিনি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা কামরুন নাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চতুর্থ শ্রেণির লোকবল সংকটের কারণে ‘কাজ নাই মজুরি নাই’ ভিত্তিতে কর্মচারী দিয়ে রেলের বিভিন্ন দফতরের কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। মূলত দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ থাকা ও নিয়োগবিধি সংস্কারের কারণে সংকটটা বেশি ছিল। এটা থেকে বের হতে চাইছে রেল। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি অর্থবছর থেকে টিএলআরদের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ কারণে অর্থ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের মহাপরিচালক কার্যালয়ের নির্দেশে অস্থায়ী কর্মচারীদের অব্যাহতি দিয়েছি।’ তবে হিসাব বিভাগে টিএলআররা কোনো টেকনিক্যাল পদে না থাকায় নতুন করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগ হলে রেলের চলমান কাজের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, রেলওয়ে একটি বিশেষায়িত জাতীয় সম্পদ। রেলের অনেক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মচারীদের। নিয়োজিত টিএলআররা নানা বিষয়ে আন্তরিকতাসহ রেলের সম্পত্তি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘রেলওয়ের স্বার্থ ও মানবিক বিবেচনায় শুরু থেকেই বলেছি আমরা আউটসোর্সিং চাই না। রেলের নতুন আইনে এটা বাতিল করতেও বলা হয়েছে। তবে এর সমাধান না হলে আমরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে পারি।’

রেলে অনেকেই বলছেন, সংস্থাটিতে অন্তত পাঁচ হাজার টিএলআর কর্মরত রয়েছেন। এসব কর্মচারীর বেতন বাবদ বার্ষিক প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয় করে রেলওয়ে। টিএলআর ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, রেল বিশেষায়িত খাত হওয়ায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগ করা হলে দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে। বিশেষত রেলের ওয়ার্কশপ, অপারেটিং কাজ, ট্রেন পরিচালনায় দীর্ঘদিনের দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। ৫ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত রেলে টিএলআর হিসেবে কাজ করা কর্মীদের বাদ দিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হলে তা রেলের মতো বিশেষায়িত সংস্থার কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

সর্বশেষ খবর