অসংখ্য শহর-নগর, বাণিজ্য কেন্দ্রের জন্ম দেওয়া একসময়ের প্রমত্তা ভৈরবকে মরণদশা থেকে বাঁচাতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী ২০১৬ সালে ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রকল্প অনুযায়ী ভৈরব নদের ৯২ কিলোমিটার খননের জন্য ২৭২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। পরে একনেকে প্রকল্পটি পাস হয়। খননকাজ শেষ হওয়ার পর নদের দুই তীর ড্রেসিংয়ের কাজ চলছে। তবে নদটিকে সচল করতে খননের পাশাপাশি এর দুই তীর থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ এবং বিভিন্ন স্থানে ভৈরবের গলা চেপে ধরা ছোট ছোট ৫১টি ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে সেখানে পরিকল্পিতভাবে ব্রিজ নির্মাণের যে কথা ছিল, এর অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। ফলে প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যশোর শহর অংশ পর্যন্ত জোয়ার-ভাটা আসার কথা থাকলেও সেটাও হচ্ছে না। শতাধিক প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে তাদের স্যুয়ারেজ লাইন ও ড্রেনের সংযোগ ভৈরবে দেওয়ায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নদটিতে পড়ে মারাত্মক দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে।
এর আগে ভৈরব নদের জমি দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা ২৯৬টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে প্রশাসন। নদের জায়গা ছেড়ে দিতে ২০১৮ সালে চূড়ান্ত নোটিস দেওয়া হয় তাদের। কিছু দখলদার নদের জায়গাকে নিজেদের জায়গা হিসেবে দাবি করে জেলা প্রশাসনে আবেদন করেন। এ ব্যাপারে তারা উচ্চ আদালতেও যান। তবে শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ৮৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রশাসন। বাকি দখলদাররা এখনো আছেন বহাল তবিয়তে।
নদের জমিতে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই স্যুয়ারেজ ও ড্রেনের সংযোগ ভৈরবের সঙ্গে দেওয়ায় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত বর্জ্য মিশছে নদের পানিতে। দূষণ সৃষ্টিকারীদের মধ্যে ব্যক্তি যেমন আছেন, তেমনি আছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, পৌরসভার ড্রেন, খামার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে সম্প্রতি এ রকম ১১৬ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে নোটিস দেওয়া হয়েছে। তবে পরিস্থিতি এখনো একই রকম আছে।নদটিকে সচল করতে সবচেয়ে বেশি বাধার সৃষ্টি করছে বিভিন্ন স্থানে থাকা ছোট ছোট ৫১টি ব্রিজ ও কালভার্ট। ভৈরবের প্রশস্ততা যেখানে শহর অংশে ১৫০ ও বাইরে ৩০০ মিটার, সেখানে এসব ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে মাত্র ১২ থেকে ৭০ মিটারের মধ্যে। এর মধ্যে ২৯টি ব্রিজ খুবই ছোট। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এসব ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি করায় পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের এসব অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট অপসারণ করার জন্য চিঠি দিয়েছে। কিন্তু আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের অভাবে এ কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, নদের গলা চেপে ধরা ৫১টি ব্রিজ-কালভার্টের মধ্যে যশোর সদরে ৩৪টি, চৌগাছা উপজেলায় ১৬টি এবং ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় একটি রয়েছে। এগুলো অপসারণ করে সেখানে পরিকল্পিতভাবে বড় আকারে ব্রিজ নির্মাণ করা জরুরি।
তবে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ দাবি করেছেন, শিডিউল অনুযায়ী ড্রেজিংয়ের কাজ হয়নি। এর মধ্যে ঘাপলা হয়েছে। নদ ড্রেজিং ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ক্ষেত্রে নদী তট আইন মানা হয়নি। ড্রেজিং করে ভৈরবের মাটি নদের মধ্যেই ফেলা হয়েছে। ফলে শহর অংশে ভৈরব সরু খালে পরিণত হয়েছে। শহরের বাইরে কোথাও কোথাও একই স্থানে ভৈরব তিনটি খালে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, নদটি সচল করতে সরু ব্রিজ-কালভার্ট অবশ্যই একটা সমস্যা। সেগুলো অপসারণ করে দিলেই তো হয়। আসলে ড্রেজিংয়ে যে ঘাপলা-দুর্নীতি হয়েছে, সেটাকে আড়াল করতেই পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন ব্রিজ-কালভার্টের কথা সামনে আনছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, ভৈরব ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখন ড্রেসিংয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, যশোর শহর থেকে ডাউনে ভৈরবের একটা বাঁধ কেটে দেওয়া হচ্ছে। এটা শেষ হতে আরও চার-পাঁচ দিন লাগবে। বাঁধটা কেটে দিলেই জোয়ার-ভাটা আসবে। তবে রাজারহাটে সরু কালভার্টে তা আটকে যাবে। যশোর শহর পর্যন্ত জোয়ার-ভাটা আনতে গেলে রাজারহাটের কালভার্টটি অপসারণ করতে হবে। নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ভৈরবের ৫১টি ব্রিজ-কালভার্টের মধ্যে ২৯টি খুবই ছোট। এগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তৈরি। এসব মন্ত্রণালয়কে ব্রিজ-কালভার্টগুলো অপসারণ করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দখলদার উচ্ছেদের ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রায় সব দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। একটি মাত্র বাকি আছে। সেটিও উচ্ছেদ করা হবে।