বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তিন-চারটি দেশের কাছে তথ্য চেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সেসব দেশ থেকে তথ্য পেলেই চার্জশিট দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। গতকাল রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটওয়ে ‘বিনিময়’ অ্যাপস ব্যবহার করে প্রায় ৯৭ লাখ টাকা লোপাটের ঘটনায় এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সিআইডি প্রধান বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির মামলাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। রিজার্ভ চুরির সঙ্গে যে তিন-চারটি দেশের লিংক রয়েছে, সে দেশগুলোর কাছে আমরা তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। সেখান থেকে তথ্য এলে আমরা দ্রুতই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আদালতে চার্জশিট জমা দেব।’ সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠিত গেটওয়ে ‘বিনিময়’ প্ল্যাটফরমে ডিজিটাল প্রতারণা করে একটি চক্র প্রায় ৯৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সাত দিন ধরে প্রতারণা করে চক্রটি এই টাকা আত্মসাৎ করেছে। বুধবার বগুড়ায় অভিযান পরিচালনা করে চক্রের হোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এ ছাড়া চক্রের আরও তিনজন সিআইডির নজরদারিতে রয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন গোলাম রব্বানী, শামীম আহমেদ ও রুহুল আমিন। এ সময় তাদের কাছ থেকে কম্পিউটারের সিপিইউ, বিপুলসংখ্যক সিমকার্ড, ব্যাংকের চেকবই, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, ১৪টি মোবাইল ফোন ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বিভিন্ন ধরনের রেজিস্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করা হয়।
মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বোধন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠিত ‘বিনিময়’ প্ল্যাটফরমে ১০ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৬ লাখ ৭৪ হাজার ২৫৭ টাকা ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। চক্রটি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সেলফিন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে ‘বিনিময়’ প্ল্যাটফরমে প্রবেশ করে। পরে তাদের নিজেদের বিকাশের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে টাকা ট্রান্সফার করার জন্য অনুরোধ পাঠায়। এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিময় তাদের প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা প্রতারকদের বিকাশের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে।কীভাবে কাজ করে বিনিময় : বিনিময় অ্যাপসটি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অর্থাৎ বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবধারীদের সঙ্গে ব্যাংক হিসাবধারীদের সংযোগ স্থাপন করে দেয়। যদি কেউ তার কোনো ব্যাংক হিসাব থেকে বিকাশ হিসাব নম্বরে টাকা স্থানান্তর করতে চান, সে ক্ষেত্রে বিনিময়ের মাধ্যমে তা স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ব্যাংকের অনলাইন অ্যাকাউন্টধারীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে টাকা স্থানান্তর করতে পারেন।
যেভাবে লোপাট হয়েছে টাকা : অভিযানে অংশ নেওয়া সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা গোয়েন্দা তথ্য থেকে ওই টাকা লোপাটের তথ্য জানতে পারেন। চক্রটি তাদের একটি বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে। ওই ব্যাংকটিতে তাদের হিসাব নম্বর আগে থেকে ছিল। ব্যাংকটির অনলাইনে লেনদেনের অ্যাপসে ঢুকে তারা ‘বিনিময়’ গেটওয়ে অপশনে যায়। কোথায় টাকা পাঠাবেন সেখানে সেই অপশন থাকে। চক্রটি এমএফএস সার্ভিস বিকাশ অপশনে ক্লিক করে যেখানে টাকা পাঠাবে সেই নম্বর দেয়। এরপর একে একে টাকা পাঠাতে থাকে। সিস্টেম অনুযায়ী বিনিময় অ্যাপস বেসরকারি ব্যাংকটির টাকা পাঠানোর মেসেজ গ্রহণ করে বিকাশ কর্তৃপক্ষকে তার হিসাবধারীর নম্বরে টাকা দিয়ে দেওয়ার ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দেয়। এই ক্লিয়ারেন্স পেয়ে বিকাশ কর্তৃপক্ষ তাদের হিসাবধারীর নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এখানে চক্রের এক সদস্যই দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছেন। এক মোবাইল থেকে ব্যাংকের অ্যাপসে গিয়ে বিনিময় গেটওয়ে হয়ে টাকা পাঠিয়েছেন। এদিকে গেটওয়ে থেকে ‘টাকা পাঠানো সম্ভব হয়নি’ বলে ব্যবহারকারীর কাছে একটি মেসেজ ফেরত আসে। অন্যদিকে গেটওয়ে থেকে বিকাশ কর্তৃপক্ষকে তার ব্যবহারকারীকে টাকা দিয়ে দেওয়ার জন্য ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে। এতে বিকাশ কর্তৃপক্ষ মোট সাতজন হিসাবধারীর মোবাইলে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। এভাবে লোপাট হওয়া প্রায় ৯৭ লাখ টাকাই বিকাশ কর্তৃপক্ষের।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বিনিময় সার্ভারের কেউ না কেউ ১০ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত তাদের সিস্টেম লসের তথ্যটি প্রতারক চক্রের কাছে পাচার করেছে। এতে চক্রটি একের পর এক টাকা পাঠানোর কমান্ড করেছে। সঙ্গে সঙ্গে চক্রের সদস্যরা টাকাগুলো ক্যাশ করে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে।