রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, ডলার সংকট, পুরনো জাহাজের সরবরাহ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে বিপর্যস্ত রয়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্প। ফলে অপার সম্ভাবনাময় এ শিল্প এবং ইস্পাত শিল্পসহ অন্য খাতেও সংকট তৈরি হচ্ছে। বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ৮০০ জাহাজ শেষ জীবনকালে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে বর্জ্যে পরিণত হয়। পরে সেগুলো বিভিন্ন দেশে রিসাইক্লিং করার যে প্রক্রিয়া সেটাই জাহাজ ভাঙা শিল্প। ২০১৫ সালের পর থেকে এ শিল্পে ব্যাপক অগ্রগতি হয় বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বে যত জাহাজ ভাঙা হয় তার ৪৭.২ শতাংশ জাহাজ সীতাকুন্ডের সমুদ্র উপকূলে হয়ে থাকে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট এ শিল্প নানামুখী সংকটে পড়তে শুরু করে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও এ খাতে ধাক্কা দেয়। ইয়ার্ড মালিকরা বলছেন, সাম্প্রতিক ডলার সংকটের কারণে সরকার কম প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করার পর পুরনো জাহাজ আমদানি কমে যায়। আবার যেসব দেশ থেকে স্ক্র্যাপ হিসেবে পুরনো জাহাজ আমদানি করা হতো, বিশ্বমন্দার কারণে সেখানকার মালিকরা পুরনো জাহাজ সংস্কার করে বেশি সময় ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। ফলে একটি জাহাজ স্ক্র্যাপে পরিণত হতে বাড়তি সময় লাগছে। ফলে এ শিল্পের প্রধান কাঁচামালের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আবার এ বছরের শুরুতে ডলারের দাম বাড়ায় যে দামে জাহাজ কেনা হতো ব্যাংকগুলোতে এলসির বিপরীতে, তার চেয়ে বাড়তি পরিশোধ করতে হতো। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সভাপতি ও তাহের গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আবু তাহের বলেন, ‘ইস্পাত শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে পুরনো জাহাজ থেকে প্রাপ্ত কাঁচামালের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক আমাদের এলসি দিচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারত এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু এ শিল্প আমদানি নির্ভর। এলসি না দিলে ইয়ার্ড বন্ধ করে দেওয়া ছাড়ার আর কোনো উপায় নেই।’ বিএসবিআরএয়ের হিসাবে, চট্টগ্রামের সিটি গেট থেকে কুমিরা পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলীয় অঞ্চলে ছোট-বড় ১২০টির মতো রেজিস্টার্ড শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৮০টির বেশি ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার কাজ চলে। পুরনো জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ায় বর্তমানে ৩০টির মতো ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার কার্যক্রম চলছে। বাকি কাজ বন্ধ রেখেছে। এসব ইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকরা বেকার সময় পার করছেন। স্বাভাবিক সময়ে এসব ইয়ার্ডে ১৫ লাখ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ মজুদ থাকে। বর্তমানে মজুদের পরিমাণ খুবই কম। বিএসবিআরএয়ের সচিব (অফিসিয়াল সেক্রেটারি) নাজমুল হাসান জানান, চলতি বছরের এপ্রিলের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে পুরনো জাহাজ আমদানি কমতে শুরু করেছে। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে যথাক্রমে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৭ টন, ১ লাখ ৩০ হাজার ৭০৫ টন ও ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৭৫ টন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়।
কিন্তু এপ্রিলের পর থেকে জুলাই পর্যন্ত আমদানির পরিমাণ কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে আসে। এর মধ্যে এপ্রিলে ১ লাখ ৯ হাজার ৯২০ টন, মে মাসে ৪৩ হাজার ৬৮৬ টন, জুনে ৮৮ হাজার ২২৬ টন ও জুলাইতে ৫৬ হাজার ৮৪ টন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির পরিমাণ উল্লেখ করার মতো বাড়ছে না।বিএসবিআরএ বলছে, ২০১৫ সালে ২২১টি, ২০১৬ সালে ২৫০টি, ২০১৭ সালে ২১৪টি, ২০১৮ সালে ১৯৬টি ও ২০১৯ সালে ২৩৬টি জাহাজ পুনর্ব্যবহারের জন্য সীতাকুন্ডের ইয়ার্ডগুলোতে ভাঙা হয়। এ শিল্পে ৭০ হাজারের মতো লোক সরাসরি কাজ করেন। এ ছাড়া আরও ৩০ লাখ লোক পরোক্ষভাবে এই শিল্পে জড়িত। এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে জাহাজ নির্মাণ, হালকা প্রকৌশল, ফার্নিচারসহ বেশ কিছু স্থানীয় শিল্প গড়ে উঠেছে। এ শিল্পের সংকটের ফলে এসব খাতেও সংকট তৈরি হচ্ছে।
এ শিল্পের যে সংকট তা প্রভাব ফেলছে ইস্পাতেও। ২০১৫ সালের পর থেকে ইস্পাত কোম্পানিগুলো প্রধান কাঁচামাল বিলেট আমদানি কমিয়ে শিপইয়ার্ডগুলো থেকে লোহা সংগ্রহ করে এবং নিজেরাই বিলেট তৈরি শুরু করে। ফলে ইস্পাত শিল্পেও প্রচুর অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ তৈরি হয়।
ইয়ার্ড মালিকরা বলছেন, একদিকে উপকূলীয় পরিবেশ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পরিবেশ দূষণ কমাতে নীতিমালা অনুযায়ী গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত করার কাজ চলছে। ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাদ দিয়ে স্ক্র্যাপ ওঠা-নামার জন্য ম্যাগনেট ক্রেনসহ আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক সংকট, জাহাজের পরিমাণ কমে যাওয়া, জাহাজ আনার ক্ষেত্রে আগাম কর প্রদানের মতো বিষয়গুলো এ শিল্পকে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।