শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

৯৯৯-এ আস্থা বাড়ছেই, ঈদে থাকবে নিরবচ্ছিন্ন সেবা

আলী আজম

ঈদুল ফিতরের ছুটিতে অনেক মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করবেন তারা। সবাই যেন আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারেন সে জন্য সক্রিয় থাকবে জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইন (৯৯৯)। যে কোনো সমস্যায় ট্রিপল নাইন জনগণের পাশে আছে। সমস্যার দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করবে তারা। সহায়তার প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো ট্রিপল নাইনে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশি সেবা পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে ক্রমেই আস্থা বাড়ছে জরুরি এই সেবার ওপর। বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করছে সেবাটি। ট্রিপল নাইন সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা বলছেন, ঈদ উপলক্ষে ট্রিপল নাইনের বিশেষ সেবা বাড়ানো হয়েছে। লোকবল বাড়ানো হয়েছে। ঈদে একজন গ্রাহক যেন ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রিপল নাইনের সেবাটি পান সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত গ্রাহক বা ভুক্তভোগীর সেবাটি নিশ্চিত করা হবে। গত পাঁচ বছর চার মাসে সরাসরি সমাধানযোগ্য কলের মধ্যে পুলিশ সার্ভিসিং দেওয়া হয়েছে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯৫টি; ফায়ার সার্ভিসিং ১ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩০টি এবং অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসিং ১ লাখ ১৮ হাজার ২৭৮টি।

 

২ এপ্রিল রাতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানার দুই নম্বর ওয়ার্ডের শাকুয়াইল খালপাড় মহিলাবাজার থেকে মো. হারুন নামে একজন জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) ফোন করেন। তিনি জানান, আবুল কালাম নামে এক ব্যক্তিকে পূর্বশত্রুতার জের ধরে দুর্বৃত্তরা হাত-পা বেঁধে মারধর করছে এবং গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি এ অবস্থায় দ্রুত পুলিশি সহায়তার অনুরোধ জানান। ট্রিপল নাইন থেকে হালুয়াঘাট থানা পুলিশকে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ আবুল কালামকে উদ্ধার করে। পাশাপাশি মারধর ও অগ্নিসংযোগ করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করে।

২৮ মার্চ বিকালে বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী উপকূলের নিকটবর্তী অবস্থানে থাকা এনডিই-১৪ নামে একটি লাইটার জাহাজের একজন নাবিক আলী আজগর ট্রিপল নাইনে ফোন করেন। তিনি জানান, তারা চীনা পতাকাবাহী মাদার ভ্যাসেল ‘ক্যাং হুয়ান-১’ থেকে মালামাল লোড করার জন্য সেখানে অবস্থান করছিলেন। মাদার ভ্যাসেল থেকে ১২ জন চীনা নাবিক একটি স্পিডবোট নিয়ে সাগরে নামার সময় লিফটের তার ছিঁড়ে ওপর থেকে সাগরে পড়ে উল্টে যায়। এর মধ্যে দু-একজন নাবিক বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেও বাকি সবাই ওল্টানো বোটের ভিতর আটকা পড়েন। আশপাশের কিছু বোট এগিয়ে এলেও ওল্টানো স্পিডবোটের ভিতর থেকে নাবিকদের উদ্ধার করতে পারেনি। কলার এ অবস্থায় দ্রুত পুলিশি সহায়তার অনুরোধ জানান। ট্রিপল নাইন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোস্টগার্ড চট্টগ্রাম পূর্ব জোনকে বিষয়টি অবহিত করে দ্রুত উদ্ধারের অনুরোধ জানানো হয়। পরে কোস্টগার্ড চট্টগ্রাম পূর্ব জোনের একটি উদ্ধারকারী দল দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ১২ চীনা নাবিককে জীবিত উদ্ধার করে এবং তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নিরাপদে উপকূলে পৌঁছে দেয়।

২০ মার্চ সকালে ঢাকার ধামরাই থেকে হাবিবুর রহমান নামে একজন কলার ট্রিপল নাইনে ফোন করেন। তিনি জানান, তার ঢাকা মেট্রো ল-৫২-৯৩২৭ নম্বরের নীল রঙের অ্যাপাচি আরটিআর ফোর ভি মোটরসাইকেলটি সকালে চুরি হয়েছে। তিনি জিপিএস লোকেশন ট্র্যাকারের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছিলেন মোটরসাইকেলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলন্ত অবস্থায় চৌদ্দগ্রামের কাছাকাছি রয়েছে। ট্রিপল নাইন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ময়নামতি হাইওয়ে থানা ও মিয়াবাজার হাইওয়ে থানাকে জানিয়ে দ্রুত উদ্ধারের অনুরোধ করা হয়। পরে মিয়াবাজার হাইওয়ে থানা পুলিশের একটি দল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার মিশ্বানী বাজার থেকে মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করে এবং চুরির অভিযোগে মো. তুষার আহমেদ নামে একজনকে গ্রেফতার করে।

এভাবেই জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে ইতোমধ্যে আস্থা অর্জন করেছে ট্রিপল নাইন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর সেবাটি চালুর পর থেকে চলতি বছর ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ বছর ৪ মাসে ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৯০ হাজার ৬৩৪টি কল এসেছে। এর মধ্যে ১২ লাখ ৪২ হাজার ১০৩টি কল সরাসরি সমাধানযোগ্য ছিল। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, মোট ১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৩৫টি কলের বিপরীতে কোনো না কোনোভাবে সার্ভিস দেওয়া হয়েছে, যা মোট কলের ৪১.৬০ শতাংশ। পাশাপাশি ট্রিপল নাইনে অপ্রয়োজনে অনেকে ফোন করছেন। দিচ্ছেন মিথ্যা তথ্যও। গেল ৫ বছর ৪ মাসে ট্রিপল নাইনে ২ কোটি ৬৬ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৯টি অপ্রয়োজনীয় কল এসেছে, যা মোট কলের ৫৮.৪০ শতাংশ। এর মধ্যে বিরক্তকর কলই ছিল ২৩ লাখ ৩৭ হাজার ৬৮৩টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রিপল নাইনের বিষয়ে প্রচারণার অভাব রয়েছে। এই কার্যক্রমের ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি করা উচিত। তবে তথ্যদাতা যে-ই হোক না কেন তাকে বেশি বিরক্ত করা যাবে না। তার কাছ থেকে একবারই তথ্য নিতে হবে। নইলে পরবর্তীতে তিনি তথ্য দিতে বিমুখ হবেন। অন্যরাও আগ্রহ হারাবে। শুধু পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কিংবা অ্যাম্বুলেন্স নয়, এর সঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসাসহ মাঠপর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন সামাজিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে জনগণ এই সেবা থেকে বেশি উপকৃত হবে।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই বিরক্তিকর কলের জন্য দন্ডের বিধান রেখে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ধারা ৭০(১) সংশোধন করা হয়। এ আইনে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কল দিলে তার ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদন্ড হতে পারে।

জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনের (৯৯৯) প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ বলেন, ‘জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রিপল নাইনের সেবা। দিন যত যাচ্ছে ততই ট্রিপল নাইনের প্রতি জনগণ আস্থা ও ভরসা রেখেই চলেছে। জনগণ যখন বিপদে পড়ছে তখনই ট্রিপল নাইনে ফোন দিচ্ছে। তাই এ সেবাটির চাহিদা বাড়ছে। বাড়ছে সেবার মানও। আমাদের দক্ষ কর্মী বাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে জনগণকে সেবাটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। তবে জনগণ কিছু বিষয় জরুরি মনে করে কল দিলেও সেগুলো আমাদের কাছে জরুরি নয়। কারণ ট্রিপল নাইনে সব বিষয়ে সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়। কেবল পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দেওয়া সম্ভব।’

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ট্রিপল নাইন চালুর পর থেকে অপ্রয়োজনীয় কলের সংখ্যা বেশি ছিল। এখন তা অনেক কমে আসছে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রিপল নাইনের কর্মী বাহিনী দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জনগণকে নির্বিঘ্নে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। দেশের সব মেট্রোপলিটন এলাকায় ও কিছু জেলা শহরে এমডিটি (মোবাইল ডাটা টার্মিনাল) ও টিডিএস (থানা ডেসপাস সিস্টেম) চালু করার ফলে সেবাটি আরও সহজ হয়েছে। ট্রিপল নাইন সেবাটি গ্রহণ করে জনগণ খুশি। শতাধিক জনবল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে জনবল রয়েছে ৪ শতাধিক। ট্রিপল নাইন একসঙ্গে ৮০টি কল রেসপন্স করতে পারে।

প্রতিদিন গড়ে ২৫ হাজার কল আসছে। এর মধ্যে সার্ভিসযোগ্য কল আসছে ৪১.৬০ শতাংশ। বিরক্তিকর বা অপ্রয়োজনীয় কল এড়াতে ট্রিপল নাইনে যুক্ত হচ্ছে অটোকলার। গ্রাহক ট্রিপল নাইনে ফোন দিলেই তার লোকেশন ও পরিচিতি অটোমেটিক চলে আসবে। ট্রিপল নাইন কর্তৃপক্ষ কেবল গ্রাহকের সমস্যা শুনবে এবং দ্রুত সেবা দেওয়া চেষ্টা করবে। ট্রিপল নাইনে অটোকলার যুক্ত হওয়ায় বিরক্তিকর কল কমে যাবে। কেউ বিরক্তিকর কল দিলেই তার বিরুদ্ধে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অটোকলারের একটাই লক্ষ্য, ভুক্তভোগী গ্রাহকদের দ্রুত সেবা দেওয়া।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে প্রথমে কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে ৯৯৯ নম্বরে জাতীয় হেল্প ডেস্ক চালু করা হয়। ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সেখানে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলে। ৮ অক্টোবর ৯৯৯ নম্বর পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২৬ অক্টোবর থেকে ৯৯৯-এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ।

২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রাজধানীর আবদুল গণি রোডে পুলিশের ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ফায়ার সার্ভিস, জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশি সেবা দিতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। মোবাইল ও ল্যান্ডফোন থেকে সম্পূর্ণ টোল-ফ্রি কল করে বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে এ সেবা নেওয়া যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর