সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেপরোয়া চোরাচালান সিন্ডিকেট

ভারত থেকে অবাধে আসছে চিনি গরু মহিষ মাদক, লেনদেন হচ্ছে হুন্ডিতে

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

বেপরোয়া চোরাচালান সিন্ডিকেট

সিলেটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাচালান সিন্ডিকেট। পুলিশ-বিজিবির কড়া নজরদারি ও অভিযানের পরও বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান। সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিদিন ভারত থেকে নিয়ে আসছেন চিনি, গরু, মহিষ ও মাদক। চলতি বছরের শুরু থেকে গত শনিবার পর্যন্ত পুলিশ ও বিজিবি মিলে আটক করেছে ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫২৫ কেজি চিনি। চিনি ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও আটক হচ্ছে ভারতীয় গরু, মহিষ ও মাদক। আর চোরাচালানির মাধ্যমে আসা এসব পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভারতে। চোরাচালান রোধ করা না গেলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসারও আশঙ্কা করছে সচেতন মহল। তবে বিজিবি ও পুলিশ বলছে তারা এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে।

সূত্র জানান, সিলেট জেলার তিন দিকেই ভারত সীমান্ত। জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে সীমান্তবর্তী উপজেলা হচ্ছে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোরাচালান হয়ে থাকে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে। এই চার উপজেলার সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ভারতীয় চিনি, গরু ও মহিষ আসছে। এ ছাড়া সব কটি সীমান্ত দিয়ে আসছে মাদক। এর মধ্যে বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বেশি আসছে ইয়াবা ও ফেনসিডিল। আর বাকি সীমান্তগুলো দিয়ে আসে অফিসার্স চয়েজ মদ ও গাঁজা। এ ছাড়া জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্র ও বিস্ফোরক বিভিন্ন সময় আটক হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে। ফলে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসার আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল। এদিকে চোরাচালের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতারাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারদলীয় নেতারাই চোরাচালান সিন্ডিকেটকে মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। চিনি চোরাচালানের সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে কয়েক দিন আগে সংগঠনটির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট প্রবাল চৌধুরী পুজন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এর জের ধরে তার ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এ ঘটনায় পুজন বাদী হয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদকসহ ৩০০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। তবে হামলার কথা ও পুজনের অভিযোগ অস্বীকার করেন ছাত্রলীগ নেতারা।

পুলিশ ও বিজিবি সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত সিলেট জেলায় ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫২৫ কেজি ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিজিবি উদ্ধার করেছে ২ লাখ ৬৭ হাজার কেজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ ১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬ কেজি ও জেলা পুলিশ ৭১ হাজার ৪৯ কেজি চিনি। চোরাচালানের ঘটনায় মেট্রোপলিটন পুলিশ ৮২ জনকে আটক ও ৫০টি মামলা দায়ের করেছে। আর জেলা পুলিশ ২৩টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি ১৯ জনকে আটক করেছে।

সূত্র জানাই, চোরাচালানের মাধ্যমে আসা পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় ভারতের ব্যবসায়ীদের হাতে। সীমান্তবর্তী প্রায় প্রতিটি উপজেলায় রয়েছেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। তাদের মাধ্যমেই মূলত দুই দেশের চোরাকারবারিরা লেনদেন করে থাকেন। চিনি, গরু ও মহিষের জন্য বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা ভারতে অগ্রিম টাকাও পাঠিয়ে থাকেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। টাকা পাওয়ার পর চোরাচালান সিন্ডিকেটের ভারতীয় সদস্যরা নির্দিষ্ট পণ্য বাংলাদেশে পাঠিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সীমান্তে চোরাই পণ্য প্রবেশের পরই এর দায়িত্ব নেন এ-দেশীয় সদস্যরা। টাকা নিয়ে গরু না দেওয়ায় প্রায় এক মাস আগে ভারতীয় এক চোরাকারবারিকে অপহরণ করে কানাইঘাট এনে আটকে রাখা হয় বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পায়। তবে আটকে রেখে টাকা আদায়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে বলে জানা গেছে।

চোরাচালান প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ জানান, যখনই চোরাচালানের খবর পাওয়া যায় তখন দ্রুততার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র, বিস্ফোরক কিংবা চোরাচালান করা কোনো পণ্য যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য মহানগরীর প্রবেশপথ লামাকাজি, বটেশ্বর ও বিমানবন্দর এলাকায় পুলিশের চৌকি বসানো হয়েছে। পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এই চৌকির কার্যক্রম তদারক করে থাকেন।

সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, সীমান্ত এলাকায় পুলিশের গোয়েন্দা তৎপরতা রয়েছে। চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যদের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি তাদের নজরদারি করা হচ্ছে। চোরাচালান এবং অস্ত্র ও মাদক কারবারিদের ব্যাপারে জেলা পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক রয়েছে এবং কাজ করছে।

বিজিবি সিলেটের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সেলিম হাসান জানান, সীমান্ত এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। এর পরও চোরাকারবারিরা কিছু পণ্য নিয়ে আসেন। চোরাচালান রোধে বিজিবি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যে কারণে বিভিন্ন সময় অভিযানে সীমান্ত দিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চিনি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। মাদক ও অস্ত্রের ব্যাপারেও বিজিবি আপসহীন কাজ করছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর