মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নালা ড্রেন যেন মৃত্যুফাঁদ

দুই বছরে মৃত্যু আটজনের, পাহাড় ধসে মারা যাচ্ছেন অনেকেই

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

নালা ড্রেন যেন মৃত্যুফাঁদ

চট্টগ্রাম নগরের নালা-নর্দমা ও ড্রেনগুলো এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হওয়া নগরের নালা-নর্দমাগুলোতে পড়ে মানুষ মৃত ও নিখোঁজ হচ্ছেন। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো এখন একেকটি মৃত্যুকূপ। এছাড়া প্রতি বছরই বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসে মরছে মানুষ। ফলে নগরের পাহাড় ও নালা-নর্দমাগুলো এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। গত দুই বছরে নালায় পড়ে আটজন এবং পাহাড়ধসে বছরে মারা যাচ্ছে গড়ে আটজন। অভিযোগ ওঠেছে, পাহাড়ের মালিক সরকারি সাত সংস্থা। সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই দাপট দেখিয়ে ঘর তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। ফলে মালিকই পাহাড় রক্ষায় উদাসীন। জেলা প্রশাসন বারবার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও তাদের তৎপরতায় অবৈধরা ফের ফিরে আসে। এ নিয়ে ৮ আগস্ট পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়। প্রশ্ন উঠে, কী করে সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিবেশ অধিদফতরের পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে দায়সারা মামলা করা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়। নগরে সরকারি-বেসরকারি ২৬টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবার। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে পরিবারগুলোকে সরানো হয়। কিন্তু তারা আবারও ঝুঁকি জেনেও ফিরে আসেন। অথচ পাহাড়গুলো আমাদের নয়। পাহাড়ের মালিকদের আমরা  ঝুঁকির বিষয়ে বারবার বলে আসছি, কিন্তু সংস্থাগুলোর আশানুরূপ সাড়া মিলে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুহিববুল্লাহ বলেন, ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে সাত থেকে আটজন পাহাড়ধসে মারা যাচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ হলো পাহাড়ের প্রাকৃতিক অবস্থা নষ্ট করা। পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড় কাটাসহ নানা কারণে বালুকাময় পাহাড়গুলোর নড়বড়ে অবস্থা। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ধস হচ্ছে। তাছাড়া, বৈশি^ক কারণে গত কয়েক বছর বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এ বছরের মতো বৃষ্টি হলে দুর্ঘটনা আরও বাড়ত। তাই পাহাড়গুলো এখন থেকেই রক্ষা করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, বর্ষার আগে থেকেই নগরের নালা-নর্দমা ও ড্রেনগুলো সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কাজগুলো করা হচ্ছে। তাছাড়া, জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের অধীনেও নগরের বড় নালাগুলোর উন্নয়ন করা হচ্ছে। তবে এর বাইরেও অনেক নালা থেকে গেছে। পর্যায়ক্রমে এগুলো পরিষ্কার করা হবে। 

গতকাল সরেজিমন গিয়ে দেখা যায়, ২০২১ সালে নগরের যে নালায় পড়ে ব্যবসায়ী নিখোঁজ হন, সে নালাটি এখনো উন্মুক্ত। নালার পাশ দিয়েই পথচারী ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। জলাবদ্ধতা হলে নালা আর সড়ক একাকার হয়ে যায়। কেবল এখানে নয়, নগরের অনেক নালা-নর্দমায় নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী।   

এর মধ্যে মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে বড় উন্মুক্ত নালা, বহদ্দারহাট থেকে বাসটার্মিনাল পর্যন্ত সড়কের পাশে, আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেটসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কের পাশে নিরাপত্তা দেয়াল ছাড়াই নালা-নর্দমা আছে। 

বর্তমানে চসিকে বড় নালা আছে ১৫১টি এবং ছোট নালা আছে ১ হাজার ৫০০টি। ছোট ড্রেন আছে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার এবং ৩ ফুট প্রস্থের বড় ড্রেন আছে ৬৫১ কিলোমিটার। চসিকের নিয়মিত এসব নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার কথা।

নিখোঁজ ব্যবসায়ীর সন্তান সাদেক উল্লাহ মাহিন বলেন, নালায় পড়ে আমার বাবা নিখোঁজ হলেন। দুই বছর পার হলেও তার কঙ্কালটাও পেলাম না। সন্তান হিসেবে আমার জন্য এটি বড় দুঃখের। অথচ এ নিয়ে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো নীরব।

 

নালা-ড্রেনে পড়ে মরছে মানুষ

গত রবিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর রঙ্গীপাড়ার কেএম হাশিম টাওয়ার এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় ইয়াছিন আরাফাত নামের দেড় বছরের শিশু। গতকাল সকালে বাড়ির পাশের একটি নালা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে গত ৯ এপ্রিল নগরের সদরঘাট নালাপাড়া এলাকায় নালায় পড়ে তিন বছরের শিশু ওজাইফা মারা যায়। ৯ আগস্ট হাটহাজারী কলেজের শিক্ষার্থী নীপা পালিত মারা যান নালায় পড়ে। ২০২১ সালের ৩০ জুন নগরের ষোলোশহর চশমা হিল এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা খালে পড়ে নিখোঁজ হয় তিনজন। পরে চালকসহ দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুরে উন্মুক্ত নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সালেহ আহমদ। দুই বছর পরও তার লাশের খোঁজ মিলেনি। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কে মাজার গেট এলাকায় নালায় পা পিছলে পড়ে নিখোঁজ হন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া। পরদিন তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৭ ডিসেম্বর নগরের ষোলোশহর চশমা খালে পড়ে নিখোঁজের তিন দিন পর লাশ উদ্ধার করা হয় কামাল উদ্দিন নামে এক শিশুর। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই আগ্রাবাদ সিএন্ডবি কলোনির পাশে বিল্লাপাড়া এলাকায় জলাবদ্ধতার সময় নালায় পড়ে অটোরিকশাচালক ও যাত্রীর মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ২ জুলাই রাতে নগরের এম এম আলী রোডের নালায় পড়ে মারা যান সরকারি কর্মকর্তা শলীব্রত বড়ুয়া।

 

থামছেই না পাহাড়ধসে মৃত্যু

চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে মৃত্যু থামছেই না। ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড়ধসে একদিনেই মারা যায় ১২৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জন মারা যান। ২০১৩ সালে মতিঝরনায় দেয়াল ধসে মারা যান দুজন।  

২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান তিনজন এবং ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে মা-মেয়ে মারা যায়। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে প্রাণ হারায় ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যায় চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকায় পাহাড়ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২০২২ সালের ১৭ জুন পাহাড়ধসে মারা যায় চারজন। সর্বশেষ গত রবিবার সকালে নগরের ষোলোশহর এলাকায় পাহাড়ধসে পিতা-কন্যার মৃত্যু হয়।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর