শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে সিলেট

সক্রিয় চ্যুতির কারণে ভয়াবহ ভূমিকম্পের শঙ্কা, ঝুঁকি মোকাবিলায় নেই কার্যকর উদ্যোগ ও সক্ষমতা

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

ডাউকিসহ একাধিক চ্যুতি সক্রিয় থাকায় সিলেট অঞ্চলকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ডাউকি ফল্ট ও আশপাশ এলাকায় প্রায়ই উৎপত্তি ঘটছে মাঝারি ও মৃদু ভূমিকম্পের। ঘন ঘন এরকম কম্পন ভয়াবহ ভূমিকম্পের আগাম বার্তা বলছেন ভূতত্ত্ববিদরা। তবে ‘রেড জোনে’ থাকলেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সিলেটে কোনো প্রস্তুতিই নেই। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে নগরে গড়ে ওঠা ৪২ হাজার ভবনের তিন-চতুর্থাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এ ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলা ও উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর মতো সক্ষমতা নেই সিটি করপোরেশন কিংবা ফায়ার সার্ভিসের।

সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্র জানান, সিলেট নগরীতে প্রায় ৪২ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবন কোনো ধরনের বিল্ডিং কোড না মেনেই নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাউকি চ্যুতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটের ৭৫ ভাগ ভবন ধসে পড়বে। এরকম দুর্যোগ দেখা দিলে উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর মতো সক্ষমতা নেই সিলেট সিটি করপোরেশন কিংবা ফায়ার সার্ভিসের। সংস্থা দুটির কাছে হাতেগোনা কয়েকটি ড্রাম ট্রাক, বুলডোজার, অগ্নিনির্বাপন গাড়ি ও যৎসামান্য যন্ত্রপাতি ছাড়া কোনো সাপোর্ট নেই।

সিলেটের অনতিদূরে ভারতের মেঘালয়ে ডাউকি চ্যুতি। সিলেটের নিচে দিয়ে এ চ্যুতির বিস্তৃতি। তাই ডাউকি ফল্ট কিংবা এর নিকটবর্তী কোথাও মৃদু ভূমিকম্প হলেই নড়েচড়ে উঠছে সিলেট। ২০২১ সালের মে মাসে ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটে ১০ দফা ভূমিকম্প হয়। ওই সময় ডাউকি ফল্ট ছাড়াও সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল মৃদু ভূমিকম্পের উৎপত্তি। ছোট একটি নির্দিষ্ট এলাকা ঘিরে এরকম মৃদু ভূমিকম্প ভাবিয়ে তোলে বিশেষজ্ঞদের। ওই সময় আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ভূগর্ভে ডাউকি ফল্ট থেকে অনেক চিড় (উপচ্যুতি) তৈরি হয়েছে। এসব উপচ্যুতির কারণে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কম্পন অনুভূত হয়েছে। এটি বড় ভূমিকম্পের একটি পূর্বাভাস বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে, ২০২১ সালে ১০ দফা ভূমিকম্পের পর সিলেট সিটি করপোরেশন কিছুটা নড়েচড়ে বসে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নগরীর কয়েকটি বিপণিবিতান ও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে তারা। ওইসব বিপণিবিতান বন্ধও করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া নগরীর প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করারও ঘোষণা দেয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু কয়েক দিন পরই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ফের চালু করা হয়। আর আর্থিক সংকটের কথা বলে ভবন পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগও থমকে যায়। গত এক মাসে তিন দফা কম্পনের পর ফের সিলেটে আতঙ্ক চেপে ধরেছে ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি উঠেছে সর্বমহলে। কিন্তু সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারি কোনো দফতরের পক্ষ থেকে বিষয়টি আমলেই নেওয়া হচ্ছে না।

আবহাওয়া অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছরে সংঘটিত ভূমিকম্পের অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভিতরে। যার মধ্যে অধিকাংশই সিলেট অঞ্চলে। বিশেষজ্ঞরা জানান, বারবার ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার চ্যুতির লাইনগুলো সক্রিয় আছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম গণমাধ্যমকে জানান, নগরীর ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘সব ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবন যে ভেঙে ফেলতে হবে তা নয়, রেক্টোফিটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।’ সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন সময় অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন ব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কারের জন্যও মালিকপক্ষকে বলেছিলাম। তারা তা শোনেননি। ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করে বসেন।’ তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের ঝুঁকি কিংবা ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সিটি করপোরেশনের খুব বেশি সক্ষমতা নেই। কয়েকটি যানবাহন ও যন্ত্রপাতি আছে। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী। কয়েক বছর আগে কিছু স্বেচ্ছাসেবীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশিক্ষণ চালু না রাখায় স্বেচ্ছাসেবীরাও আগ্রহ হারিয়েছেন।’

সিলেটে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিলেটের বেশির ভাগ ভবন অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। সিলেটের অলিগলিও সরু। পাড়ার ভিতরে অগ্নিকান্ড হলেই ঢোকা যায় না। আর ভূমিকম্প হলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে সেটি অকল্পনীয়।’

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর