বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরিচর্যার অভাবে মরছে ৩৩ নদী

উচ্ছেদে বড় বাধা মামলা

নজরুল মৃধা, রংপুর

পরিচর্যার অভাবে মরছে ৩৩ নদী

রক্ষণাবেক্ষণ না করায় মরে যাচ্ছে রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ খোকসা ঘাঘট নদী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রংপুরের নদনদীতে রয়েছে হাজারো দখলদার। মূলত আরএস, সিএস রেকর্ডের সময় থেকেই শুরু হয় নদনদীর অবৈধ দখল। ওই সময় থেকে অনেকেই নদীর জমি নিজ নামে রেকর্ড করে ভোগদখল করছেন। আবার কেউ কেউ অন্যত্র বিক্রিও করেছেন। কিছু দখলদার আদালতে মামলা করে দখল ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও মামলা করে জমির দখল উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সঠিক পরিচর্যার অভাবে নদীগুলো মরতে বসেছে। অনেক স্থানে দখলদারদের বাধার কারণে খননকাজও ঠিকমতো করা যাচ্ছে না।

সিটি করপোরেশন এলাকা দিয়ে সাতটি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর সবকটিই অবৈধ দখলদার রয়েছে। এছাড়া বদরগঞ্জের মরাতিস্তা, তারাগঞ্জের মরাধাইজান, চিকলী, কাউনিয়ার বুড়াইল ও মানাস, পীরগাছার মানাস, মিঠাপুকুরের শালমারা ও পীরগঞ্জের আখিরায় রয়েছে শত শত অবৈধ দখলদার। অনেক স্থানে নদী দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। রংপুর নগরী দিয়ে প্রবাহিত ঘাঘট, শ্যামাসুন্দরী, ইছামতী, বুড়াইল, খোকসা ঘাঘট ও আলাইকুমারী নদী নানাভাবে দখল করে রাখা হয়েছে। কোনো নদীর পানির প্রবাহ স্বাভাবিক নেই। শ্যামাসুন্দরীকে কেউ কেউ খাল বললেও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় রাজা জানকীবল্লভ সেন এটি পুনরায় খনন করেছিলেন। শ্যামাসুন্দরীর ১৭০ অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হলেও ১১ জনের আপত্তির কারণে উচ্ছেদ অভিযান থমকে রয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর পূর্ব প্রান্তে সাতমাথা যাওয়ার পথে পড়ে খোকসা ঘাঘট। এই নদীটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও এই নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। স্থানীয় আসাদুজ্জামান বলেন, তিনি তার বাব-দাদার কাছে শুনেছেন খোকসা ঘাঘট একসময় খরস্রোতা নদী ছিল। এই নদীটি ঘিরে জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। কালের পরিক্রমায় দখল এবং দূষণে এই নদীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। সাতমাথা থেকে কিছুদূর এগোলে নগরীর পুরনো শহর বলে খ্যাত মাহিগঞ্জে যাওয়ার পথেই ইছামতী নদী। এটি এখন নদীও নয় খালও নয়। নদীর দুই পাশ দখল করে স্থানীয়রা গড়ে তুলেছে বসতভিটা। মাহিগঞ্জের হাসেম আলী বলেন, ইছামতী নদী ঘিরে মাহিগঞ্জে একসময় নদীবন্দর ছিল। সেটি হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। ইছামতীর যেটুকু অস্তিত্ব রয়েছে তাও দখল হয়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে ভরাট হয়ে গেছে। সাতমাথার কিছুটা দক্ষিণে নদী দখল করে অবৈধভাবে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।

রংপুর নগরীর সাতমাথা হয়ে দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া পার্কের মোড় এলাকায় খোকসা ঘাঘটের অবস্থান আরও করুণ। এটি নদী বলে চেনাই যায় না। এমনকি সিটি করপোরেশনের নির্মিত ড্রেনের অর্ধেকই নদীতে। বর্জ্য, বাসাবাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের ফলে খোকসা পার্কের মোড়ের ওই স্থানে দুর্গন্ধে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, এই নদীর দুই পাড়ে শত শত মানুষ ঘরবাড়ি তৈরি করে বাস করছেন। এছাড়া অবৈধভাবে অনেকেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ফলে নদীর অস্তিত্ব যেটুকু রয়েছে তা দখল ও দূষণে মরে যাচ্ছে।

এদিকে রংপুর নগরীর প্রাণকেন্দ্র দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরী খালের ১৭০ অবৈধ দখল উচ্ছেদের কাজ থমকে আছে। খালের হাল জরিপে ১৭০ জন অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। উচ্ছেদ শুরুর আগে তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে নোটিস দিয়ে অবগত করা হয়। কিন্তু ১১ দখলদার আপত্তি দেওয়ায় উচ্ছেদ অভিযান আকটে রয়েছে। ফলে শ্যামাসুন্দরী আশীর্বাদের পরিবর্তে এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, রংপুর জেলায় ৩৩টির নদনদীর মধ্যে একটি নদীরও অবস্থা ভালো নেই। তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া বড় নদী হলেও এগুলোর কোনোটিরই স্বাস্থ্য ভালো নয়। বুড়াইল নামে রংপুর জেলায় মোট তিনটি আলাদা নদী আছে। ছোট আখিরা, নলেয়া, সোনামতি, কাফ্রিখাল, শালমারা, মরাতিস্তা, ঘিরনই, বুল্লাই, মানাস, বাইশাডারা, ধাইজান, খটখটিয়া নদীর অবস্থাও ভালো নয়।

নদীবিষয়ক গবেষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, রংপুরের নদীগুলোর পাড়ে এক হাজারের বেশি দখলদার আছে। নদীগুলোর যদি এখনই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করার জন্য প্রয়োজনীয় পদেক্ষপ না নেওয়া যায়, তাহলে রংপুর শহরের জলাবদ্ধতা দূর হবে না। এ নদীগুলো রক্ষা করা না গেলে এ অঞ্চলের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুই হুমকির মধ্যে পড়বে।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ‘রংপুরে মূলত নদী দখল শুরু হয়েছে সিএস এবং আরএস রেকর্ডের সময় থেকে। হাজার হাজার মানুষ সেই সময় থেকে নদী দখল করে নিজ নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন। সে সব জমি উদ্ধার করা কখনো সম্ভব নয়।’

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, খোকসা ঘাঘটের সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে বড় বাধা হচ্ছে মামলা। অনেক অবৈধ দখলদার মামলা করায় উচ্ছেদ অভিযান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শ্যামাসুন্দরী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কয়েকজন দখলদারের আদালতে আপত্তির কারণে সেখানে উচ্ছেদ অভিযান করা হচ্ছে না। তবে শ্যামাসুন্দরী দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসন কাজ করছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর