শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে বিপ্লবের স্বপ্ন

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে বিপ্লবের স্বপ্ন

কর্ণফুলী নদীর বুক চিরে তৈরি হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার নদীর তলদেশের প্রথম টানেলকে ঘিরে অর্থনৈতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। এ টানেল এশিয়ান হাইওয়ে, ভারতের সেভেন সিস্টার্স, মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর ও পরিকল্পনাধীন অর্থনৈতিক হাবের মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। টানেলকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে শুরু করে কক্সবাজার পর্যন্ত গড়ে উঠবে অসংখ্য শিল্পকারখানা। যা দেশের অর্থনীতিকে ট্রিলিয়ন ডলারে রূপান্তরের যে স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে।

সম্প্রতি এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিকে ট্রিলিয়ন ডলারে রূপান্তরের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা পূরণে ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু টানেল। এ টানেল এশিয়ান হাইওয়ে, ভারতের সেভেন সিস্টার্স এবং মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক হাবের সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সক্ষমতা তৈরি হওয়ায় জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে লক্ষ্য করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। আশা করছি চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত গড়ে উঠবে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান।’

অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামের বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূরদর্শী প্রকল্প হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল। বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। তৈরি হবে বিশাল বিনিয়োগ সম্ভাবনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলকে দেশের অর্থনীতির জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এ টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম তথা দেশের শিল্পায়ন, পর্যটন, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, এশিয়ান হাইওয়ে ও ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে সংযোগ হিসেবে কাজ করবে টানেল। এ টানেলের কারণেই চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ রূপ নিচ্ছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। টানেল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে স্থাপন হচ্ছে একের পর এক শিল্পকারখানা। নগরীতে কারখানা তৈরির পর্যাপ্ত খালি জায়গা না থাকায় এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংকটের কারণে অনেক শিল্পকারখানা স্থানান্তরিত হচ্ছে নগরীর বাইরে। পক্ষান্তরে টানেলের কারণে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় ও পর্যাপ্ত ভূমি এবং তুলনামূলক সুবিধার কারণে টানেলের দক্ষিণ পাড় ব্যবসায়ীদের কারখানা স্থাপনে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণ পাড়ে সিইউএফএল, কাফকো, কোরিয়ান ইপিজেডসহ রয়েছে রপ্তানিমুখী নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়বে বিদেশি বিনিয়োগ। টানেলকে কেন্দ্র করেই কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)। আনোয়ারার গহিরায় ৭৮৩ একর ভূমিতে স্থাপিত হচ্ছে চায়না ইকোনমিক জোন। ওই এলাকায় বিনিয়োগ হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এখানে রপ্তানিমুখী জাহাজশিল্প, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফার্নেশ ও সিমেন্ট শিল্পসহ ৩১টি শিল্পকারখানা স্থাপিত হবে। এ টানেলের পুরো সুবিধা ভোগ করবে মহেশখালীতে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর ও মহেশখালীর আগামীর বাণিজ্যিক হাব। টানেলের মাধ্যমে পুরো দেশের সঙ্গে সংযোগ হবে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন, অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাঙ্কমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোন।

এ মেগা প্রকল্পগুলোতে বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য প্রতিদিন চলাচল করবে শত শত গাড়ি। টানেলের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালসহ মেগা প্রকল্পগুলোর সংযুক্ত ঘটাবে।

চীনের সাংহাইয়ের ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’-এর আদলে চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারাকে এক সূত্রে যুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘গেমচেঞ্জার’ হতে চলেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান টানেল। এ টানেলের মাধ্যমে দেশের শিল্পায়ন, পর্যটন, অর্থনীতিসহ অন্যান্য খাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। টানেল চালু হওয়ার ফলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ। এ ছাড়া ফিন্যান্সিয়্যাল এবং ইকোনমিক্যাল ‘বেনিফিট কস্ট রেশিওর (বিসিআর) পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১ দশমিক ০৫ এবং ১ দশমিক ৫০।

সর্বশেষ খবর