শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
কক্সবাজার-১

স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ কক্সবাজার-১ আসনের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর জুলুম-অত্যাচারে এলাকার মানুষ মুখ না খুললেও এখন খুলতে শুরু করেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের বিরুদ্ধে সরকারি বনভূমি দখল, জমি দখল, চিংড়ি ঘের দখলের অনেক অভিযোগ রয়েছে। এবারের সংসদ নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে আলোচনায় এসেছে চিংড়ি ঘের দখল, গরু চুরি, সাধারণ মানুষের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণের মতো ইস্যু। গত বছরের ১৫ আগস্ট জামায়াত নেতা সাঈদীর গায়েবানা জানাজায় গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যার সঙ্গেও তাঁর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে সরকার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। জানা গেছে, কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জাফর আলম। এমপি হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তাঁর সম্পদ।

বেড়েছে স্ত্রী ও পুত্রের সম্পদও। চকরিয়া-পেকুয়ায় তাঁর কথাই যেন আইন! রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। পাহাড় কাটা, নদী দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ওই বাহিনীকে কাজে লাগান তিনি। গত বছরের ১৫ আগস্ট অস্ত্রধারীর পাশে দাঁড়িয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলম। স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে কেনা জমি দখল নিতে সোহেল নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। এ পর্যন্ত জাফর আলমের নেতৃত্বে মিছিল থেকে তাঁর বাহিনী গুলি চালিয়ে প্রতিপক্ষের অন্তত পাঁচ রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করে। তাঁর ভাতিজা জিয়াবুল হক ও ভাগনে মিজানুর রহমান গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। এ বাহিনীর নেতৃত্বে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন।

জাফর আলম ১৯ ডিসেম্বর পেকুয়ার একটি নির্বাচনি সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সমালোচনা করায় চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি পান। ২০১৮ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অল্প সময়ে মালিক হয়েছেন বিপুল অর্থসম্পদের। এমপি হওয়ার পাঁচ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ১০ গুণ। তাঁর স্ত্রী শাহেদা বেগম স্কুলশিক্ষিকা। স্বামী এমপি হওয়ার পর ফুলে ফেঁপে উঠেছে তাঁর সম্পদও। এবারের নির্বাচনি হলফনামায় তাঁর সম্পদের পরিমাণ উঠে এসেছে।

অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর অংশ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুদকের কক্সবাজার কার্যালয়ে জাফর আলম, তাঁর স্ত্রী শাহেদা বেগম, ছেলে তানভির সিদ্দিকী তুহিন ও মেয়ে তানিয়া আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

দুদকের এক সূত্র বলছেন, জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকারি জমি ও জলমহাল দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং অবৈধভাবে বালু বিক্রি করে ২৩টি দলিলে ২৪ একর জমি নামে-বেনামে কিনে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চকরিয়া ও পেকুয়ায় তিনটি মার্কেট রয়েছে তাঁর, গাড়ি রয়েছে কয়েকটি। সব মিলিয়ে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি।

দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় তাঁর বার্ষিক আয়, অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ ছিল ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৩ টাকা। যেখানে তাঁর নিজের নামে ছিল ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৩ আর স্ত্রীর নামে ৬২ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ। যৌথ মালিকানা বা তাঁর আয়ের ওপর নির্ভরশীলদের কোনো আয় ছিল না। ২০২৩ সালে এসে তাঁর বার্ষিক আয়, অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৫ টাকা। যেখানে রয়েছে তাঁর নিজের নামে ১০ কোটি ৭৮ লাখ ৬৩ হাজার ৮৯ টাকার সম্পদ। তাঁর স্ত্রীর নামে ২ কোটি ২১ লাখ ৭১ হাজার ২৫৪, যৌথ মালিকানায় ৩ কোটি ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩৫৭ এবং তাঁর আয়ের ওপর নির্ভরশীলদের রয়েছে ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৬০৩ টাকার সম্পদ।

হলফনামার তথ্য বলছে, এমপি জাফর আলমের পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৭ গুণ।

এমপি জাফর আলম পেকুয়ায় সরকারি জলাশয় ও ড্রেন ভরাট করে তাঁর মেয়ে তানিয়া আফরিন ও মেয়েজামাইয়ের নামে নিউমার্কেট নির্মাণ করেছেন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। এ মার্কেট নির্মাণে সদর ইউনিয়নের বাইম্যাখালীর মো. আলমগীরের ১ একর জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। মো. আলমগীর বলেন, ‘২০১৫ সালে জমিটি কিনি। পাঁচ বছর আমার ভোগদখলে ছিল। জাফর আলম এমপি হওয়ার পর ২০২০ সালে আমার সেই জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর ক্যাডার বাহিনীর কাছে তখন অসহায় ছিলাম। পরে এ ব্যাপারে আদালতে মামলা করি।’ এ মার্কেট নির্মাণে পেকুয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ৬০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫ মিটার প্রস্থের রাস্তাটিও দখলের অভিযোগ উঠেছে এমপির বিরুদ্ধে। এতে ১২-১৫টি পরিবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

অন্যের জমি দখল করে চকরিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছেলে তুহিন ও মেয়ে তানিয়ার নামে আরেকটি মার্কেট নির্মাণ করছেন এমপি জাফর আলম, যার বাজারমূল্য ২ কোটি টাকা। তিনি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তানিয়া আফরিনের নামে ২ একর জমি কিনে তা ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। এর মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি। তানিয়া আফরিন ও তুহিনের নামে পৌরসভার চিরিংগার বিভিন্ন স্থানে জায়গা কিনেছেন। এসব জমি অনেকটা জমির মালিককে বিপদে ফেলে কিনে থাকেন। সিস্টেমপ্লাজা নামে আরেকটি মার্কেট রয়েছে তাঁর, যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে রয়েছে শপিং মল শাহেদা কমপ্লেক্স। এ ছাড়া ছেলে তুহিনের নামে তিনি তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন বলে জানান স্থানীয়রা।

এমপি জাফরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো, তিনি চকরিয়া বাস টার্মিনালের পুব পাশে জলাশয় দখল ও ভরাট করে কয়েকজনের কাছে বিক্রি করেছেন। রামপুর মৌজায় গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দ ৩০০ একরের চিংড়ি প্রজেক্ট এক চেয়ারম্যানকে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নিয়েছেন। বরইতলী-মগনামা সড়কে নবনির্মিত বানৌজা শেখ হাসিনা ঘাঁটি সড়কে মাটি দেওয়ার নাম করে মছনিয়া কাটা এলাকায় সাবাড় করেছেন বিশাল পাহাড়। ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পড়ানোর আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে এমপি জাফরের বিরুদ্ধে। পেকুয়ায় একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের সরঞ্জাম রাখা হয়েছে উপজেলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে। এতে খেলার মাঠে আর খেলা হচ্ছে না। দুই বছর ধরে এ অবস্থা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামিল ইকবালের দাবি, এমপি জাফরের নির্দেশনায় অস্থায়ীভাবে তাঁরা সেখানে নির্মাণসামগ্রী রেখেছেন। তবে স্থানীয় ক্রীড়ামোদীরা বলছেন, বড় লেনদেনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে খেলার মাঠটি ব্যবহার করতে দিয়েছেন এমপি জাফর। পুরো মাঠে এখন ইট-বালু ও কংক্রিটের স্তূপ। জিমনেসিয়ামটি থাকার জন্য ব্যবহার করছেন শ্রমিকরা।

অভিযোগ রয়েছে, মতের অমিল হলে দলের লোককেও ছাড় দেন না সংসদ সদস্য জাফর আলম। তাঁর কারণে চকরিয়া-পেকুয়ায় আওয়ামী লীগে বিভক্তি। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোটে জয়ী হলেও এখন দলের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না তিনি। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এস এম গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘গেল ইউপি নির্বাচনে এমপি জাফরের কারণেই নৌকার অধিকাংশ প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। চকরিয়া-পেকুয়ার আওয়ামী লীগে বিভক্তি তাঁর কারণে।

চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সহসভাপিত ফজলুল করিম সাঈদীর অভিযোগ, চকরিয়া-পেকুয়ার আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন এমপি জাফর আলম। তাদের দিয়ে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করছেন না।

ফজলুল করিম সাঈদী আরও বলেন, ‘এমপি তাঁর বাহিনী দিয়ে শত কোটি টাকার জমি দখল করেছেন। প্যারাবন কেটে দখল করেছেন প্রায় ২ হাজার একর চিংড়ি চাষের জমি। নদীতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন।’ কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ সিআইপি বলেন, ‘জাফর আলম এমপি হওয়ার পর চকরিয়া-পেকুয়ার সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারী ও ডাকাতদের নিয়ে “জাফর লীগ” গঠন করেছেন। জায়গা দখল, পাহাড় কাটা ও নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে তাঁর বাহিনী। এমন কোনো অপরাধ নেই যা তাঁর বাহিনী করছে না। ভয়ে কেউ মুখও খুলতে পারছে না।’

গত বছরের ১৫ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা ঘিরে চকরিয়া পৌরশহরে সংঘর্ষের সময় মিছিলে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে ছিলেন এমপি জাফর আলম। সেই মিছিল থেকে করা গুলিতে ফোরকান নামে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সাদা পাঞ্জাবি পরা সংসদ সদস্য জাফরকে মাঝখানে রেখে শহরে মিছিলটি হয়। মিছিলের সামনে হেলমেট, হাফহাতা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এক ব্যক্তির হাতে ছিল ভারী অস্ত্র। তার পেছনে ছিলেন জাফর আলম, তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আমিন চৌধুরী, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর ও পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক জয়নাল হাজারী। তাঁদের পাশে কালো পাঞ্জাবি ও হেলমেট পরা আরেকজনের হাতে অস্ত্র দেখা যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর