শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

শীতে ফুটপাতে চাঁদাবাজির মহোৎসব

♦ রাস্তাই যেন শপিং মল ♦ দৈনিক চাঁদা উঠছে ১০ কোটির বেশি

শামীম আহমেদ

শীত আসতেই জমে উঠেছে রাজধানীর ফুটপাত ও রাস্তা ‘ভাড়া’ দিয়ে চাঁদাবাজির ব্যবসা। হকার বেড়ে হয়েছে অন্তত দ্বিগুণ। প্রতিটি ফুটপাত-অলিগলি যেন পরিণত হয়েছে শপিং মলে! ফুটপাতে জায়গা না হওয়ায় মূল রাস্তা দখল করেও বসেছে হাজার হাজার ভ্রাম্যমাণ দোকান। গুলিস্তান এলাকায় সংযোগ সড়কগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া মূল সড়কের কোথাও একটি, কোথাও দুটি লেনই হকারদের দখলে। ফলে তীব্র হয়েছে এ এলাকার যানজট। আর অবৈধভাবে হকারদের কাছে রাস্তা ভাড়া দিয়ে দৈনিক ১০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তুলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ধারী প্রায় ৭০ জন চিহ্নিত চাঁদাবাজ, যাদের অধিকাংশই একাধিক মামলার আসামি।

গত এক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধানে ফুটপাতে চাঁদাবাজির নেপথ্যে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। উঠে এসেছে প্রায় ৪০ জন শীর্ষ চাঁদাবাজের নাম-পরিচয়। সেখানে সরকার দলের পদধারীরা যেমন আছেন, আছেন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীও। রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও ফুটপাতে চাঁদাবাজিতে পাওয়া গেছে সর্বদলীয় ঐক্য। ফুটপাতে চাঁদাবাজিতে কিছু স্কুল কমিটির সভাপতি, কাউন্সিলর, পুলিশ ও অবৈধ সংগঠনের নামও উঠে এসেছে। তবে ফুটপাতের অধিকাংশ হকার চেনেন না চাঁদাবাজির মূল হোতাদের। তারা দৈনিক ভাড়া (চাঁদা) তুলে দেন লাইনম্যান হিসেবে নিযুক্ত কর্মীদের হাতে। ফুটপাত ও রাস্তা ভাড়া দিয়ে অনেকে রাজধানীতে সাত তলা বাড়িও করেছেন বলে জানা গেছে। অবৈধ আয়ের বড় উৎস হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে কথিত অভিযানেও দখলমুক্ত হয়নি সড়ক ও ফুটপাত। কাজে আসেনি হকারদের পুনর্বাসনে হলিডে মার্কেট করার উদ্যোগও। উল্টো প্রতিনিয়ত সড়কে হকার বাড়ছে।

এদিকে শীতে হকারের চাপ বৃদ্ধি ও নির্বাচনের পর নেতৃত্বে পরিবর্তন আসায় বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে চাঁদার হার। নির্বাচনের পর থেকে বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল উত্তর সিটির নিকুঞ্জ-২ আবাসিক এলাকার রাস্তার অস্থায়ী কাপড়ের দোকানগুলো। গত এক সপ্তাহ ধরে দোকানগুলো আবার খুলেছে। গল্পে গল্পে দোকান বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে হকাররা বলেন, পুলিশ এসে দোকান বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আবার অনুমতি দিয়েছে। তবে প্রতি দোকানের ভাড়া ৫০-১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আগে যারা ভাড়া (চাঁদা) নিতেন, তাদের সঙ্গে নতুন অনেকে যুক্ত হয়েছেন। এদিকে গত সোমবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ২ নম্বর গেটের বিপরীত পাশে ফুটপাত ছেড়ে মূল সড়কের অন্তত ১০ ফুট ভিতরে দোকান বসিয়ে কাপড় বিক্রি করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। এতে দুটি লেনে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এক বাইক চালক দোকানিকে রাস্তা দখলের কারণ জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন, ‘ফুটপাতে জায়গা না থাকায় রাস্তায় বসেছি। অন্য পাশ দিয়ে যান। ৬০০ টাকা ভাড়া দিয়ে এখানে বসেছি।’ এদিকে গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে দিয়ে সিটি করপোরেশনের দিকে যাওয়ার লিংক রোডটিতে হকারের কারণে যান চলাচল বন্ধ। হকাররা জানান, আগে তারা রাস্তায় বসতে ৩০০-৪০০ টাকা চাঁদা দিতেন। এখন দুই শিফটে ৩০০ করে মোট ৬০০ টাকা দিতে হয়। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ ও জিপিও এর মাঝের সড়কে বসা দোকানদাররা জানান, সেখানে বসতে দোকানের আকার ও অবস্থান অনুযায়ী এককালীন দিতে হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হয় ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। দৈনিক চাঁদা দিতে হয় ১৫০ টাকা, যার ১০০ টাকা পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের চাঁদা, ৩০ টাকা বিদ্যুৎ বিল ও ২০ টাকা দারোয়ানের খরচ।

এদিকে সড়কে দোকান বসায় বাড়ছে যানজট। ফুটপাত দিয়ে হাঁটাচলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। নারীরা অধিকাংশ সময় বাধ্য হয়ে ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। ২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্য স্টেট অব সিটিজ ২০১৬ : ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা সিটি- গভর্ন্যান্স পারসপেক্টিভ’ শিরোনামে এক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। ওই গবেষণায় ঢাকায় তখন মোট হকারের সংখ্যা বলা হয় ৩ লাখ। প্রতি হকার থেকে গড়ে দৈনিক চাঁদা আদায় হতো ১৯২ টাকা। বর্তমানে হকারদের বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে হকার আছে সাড়ে ৩ লাখ।  দৈনিক গড়ে প্রায় ৩০০ টাকা       চাঁদা আদায় হয় প্রতি হকার থেকে। সেই হিসাবে প্রতিদিন হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় হয় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা বছরে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ঈদের আগের এক মাস এই রেট দ্বিগুণ হয়ে যায়। শীতে হকার বাড়ায় রেট বাড়ে। এদিকে সড়ক ও ফুটপাত হকারমুক্ত করতে দুই সিটির মেয়র একাধিকবার ঘোষণা দিলেও কাজ হয়নি। আলোর মুখ দেখেনি হকারদের পুনর্বাসনের উদ্যোগও। বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চাঁদার ভাগ বিভিন্ন মহলে যায়। তাই হকারদের পুনর্বাসন হচ্ছে না। সড়কে হকার বাড়ছে। আগে যেখানে ৫০ জন হকার ছিল, এখন সেখানে ৭৫-১০০ জন বসে। হকারদের রাস্তায় বসিয়ে জ্যাম করে রাখছে। আমরা চাই গরিব হকাররা চাঁদাবাজদের হাত থেকে মুক্তি পাক। সেই সঙ্গে ২০১৬ সালের এপ্রিলে একনেক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হকারদের পুনর্বাসন চাই। সেই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হকারদের আইডি কার্ড দেওয়া, বিদেশে পাঠানো, ঋণ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন চাই।

কারণ হকাদেরও বাঁচতে দিতে হবে, নগরবাসীর ভোগান্তিও কমাতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর