শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

গরিবি হটিয়ে দ্রুত নিজেকে পাল্টে নিচ্ছে রংপুর অঞ্চলের মানুষ

নজরুল মৃধা, রংপুর

গরিবি হটিয়ে দ্রুত নিজেকে পাল্টে নিচ্ছে রংপুর অঞ্চলের মানুষ

কয়েক বছর আগেও দেশের সবচেয়ে গরিব ১০ জেলার পাঁচটিই ছিল রংপুর অঞ্চলে, অর্থাৎ রংপুর বিভাগে। রংপুরের আটটি জেলার পাঁচটিই ছিল দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা। ২০১৬ সালের হিসাবে কুড়িগ্রাম ছিল দেশের সবচেয়ে গরিব জেলা, যেখানে শতকরা ৭১ জনই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার মধ্যে রংপুর বিভাগের বাকি জেলা ছিল রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। এখন আগের অবস্থা নেই। রংপুর বিভাগের মানুষ গরিবি হটিয়ে দ্রুত নিজেকে পাল্টে নিচ্ছে। তারা দারিদ্র্য জয় করে সামনে এগোনোর জন্য ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

রংপুর নগরীর জিএল রায় রোডে সবুজ মিয়ার মাঝারি মানের খাবারের হোটেল। তার হোটেলের হেড বাবুর্চির বেতন ২৫ হাজার টাকা। ১২ হাজার টাকার নিচে কোনো কর্মচারীর বেতন নেই। রাস্তার পাশে পান দোকানদার আবদুল মালেক। প্রতিদিন পান বিক্রি করে তার আয় ১ হাজার টাকার বেশি। শফিকুল ইসলাম অটোচালক। প্রতিদিন আয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। পীরগাছার কৃষক নজরুল ইসলাম বুলবুলের সাত বিঘা জমি। প্রতি বছর উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা ঘরে তোলেন। ফসল ফলিয়ে এত টাকা আয় হবে- ১০ বছর আগে এটা তার কল্পনায়ও আসত না। এভাবেই বিরামহীন কঠোর শ্রমে মাত্র কয়েক বছরে রংপুরের মানুষ দারিদ্র্যকে অর্ধেকের নিচে নামিয়ে এনেছে। নিকট অতীতের দৃশ্য ছিল : কাজের অভাবে রংপুর অঞ্চলের মানুষ মঙ্গায় ভুগছে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে অভাব থাকত। এখন রংপুরে মঙ্গা শব্দটি নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুসারে রংপুর বিভাগের আট জেলার দারিদ্র্য ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে এই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৭ দশমিক ২। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে গরিবি কমিয়ে আনার রেকর্ড গড়েছে রংপুর বিভাগের মানুষ।

দারিদ্র্য কমার কারণ মনে করা হচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষের আয় বেড়ে যাওয়া আর কৃষিপণ্যের ভালো দাম পাওয়া। রংপুর অঞ্চলে প্রতি বছর লাখ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে সরকারের উন্নয়ন ও প্রণোদনা প্রকল্প। এ ছাড়া উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে লোকজন আগের  চেয়ে বেশি দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে যাচ্ছে। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিপ্রধান অঞ্চল রংপুরে প্রতি বছর  ২৫ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকে। এ পরিস্থিতি রংপুর অঞ্চলের গরিবি হটানোর সহায়ক। এ অঞ্চলে ধান কাটার মৌসুমে প্রায় ৫ লাখ কৃষি শ্রমিক শত কোটি টাকা আয় করেন।

 যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় কৃষক এবং শিল্প মালিকরা সহজেই তাদের উৎপাদিত পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে পারছেন। রংপুর বিভাগের গ্রামাঞ্চলের প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক অভিবাসী হিসেবে ঢাকায় গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন। তাদের পাঠানো টাকাও এ অঞ্চলে গরিবি কমানোয় ভূমিকা রাখছে।  

এ ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কারণে রংপুর বিভাগের দারিদ্র্য কমানোয় সহায়তা করছে। ২০১০ সালে বিভাগ ঘোষণা হওয়ার পর থেকে পাল্টে যেতে থাকে রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতি। ১০ বছরে রংপুরে সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগব্যবস্থা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে প্রচুর। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। রংপুরে হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, রংপুর পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, পীরগঞ্জে মেরিন একাডেমি স্থাপন, আদালতের বহুতল ভবন, সিভিল সার্জনের নতুন ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, আধুনিক পুলিশ লাইনস নির্মাণ, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, বিভাগীয় সদর দফতর, র‌্যাব-১৩ ব্যাটালিয়ন সদর দফতর, রংপুর শিশু হাসপাতাল ও পুলিশ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া বগুড়া থেকে নীলফামারী পর্যন্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ চালু করা হয়েছে। এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়ক উন্নয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। হাইটেক পার্ক নির্মাণ হচ্ছে। দারিদ্র্য কমাতে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা প্রকল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

রংপুর জেলা সুজনের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন বলেন, এক দশক আগেও রংপুর অঞ্চলের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য হারে দারিদ্র্য কমিয়ে রংপুরের মানুষ রেকর্ড গড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর