শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

জাবিতে আবাসিক হলের ‘সিটমন্ত্রী’ ছাত্রলীগ

রুবেল হোসাইন, জাবি

দীর্ঘদিন ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের আসন বণ্টনের দায়িত্ব পালন করছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ দায়িত্ব হল প্রশাসনের হলেও তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। তবে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে বহিরাগত স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনার পর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে সরকারের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠনই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর আসন দেখভাল করে। বর্তমানে ছাত্রলীগ নেতারা হলের ‘সিটমন্ত্রী’। হলে থাকার জন্য এবং কক্ষে আসন পেতে হলে ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ কাছে ধরনা দিতে হয়। আর হলের এ আসন বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণকে পুঁজি করে এবং ম্যানার (আচার-আচরণ) শেখানোর নামে শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, র?্যাগিং, নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, সাংবাদিক ও বিরোধী মতাদর্শের ছাত্রদের মারধরসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কখনো কখনো হলের একাধিক কক্ষকে ‘টর্চার সেল’ ও মাদক সেবনের নিরাপদ জোন হিসেবে গড়ে তোলেন তারা।

এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১ বছরে শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নিপীড়ন, শিক্ষার্থী- বহিরাগতদের মারধরসহ ৩০টিরও বেশি অভিযোগ উঠেছে। সেগুলোর মধ্যে আবাসিক হলকেন্দ্রিক ঘটনাই বেশি।

সর্বশেষ, গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে নিকটবর্তী জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান এবং বহিরাগত মো. মামুসুর রশিদ মামুন। ধর্ষণের ঘটনায় সহযোগী মো. মুরাদ এবং হল থেকে অভিযুক্তদের পালাতে সহায়তাকারী হাসানুজ্জামান, সাগর সিদ্দিকী এবং মো. সাব্বির হাসান সাগরও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্যানুযায়ী, জাবিতে বর্তমানে ২১টি আবাসিক হল রয়েছে। এর মধ্যে দুটি হল এখনো চালু হয়নি। সেগুলো চালু হলে মোট আসন সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৩৬২টি। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মোট ১২ হাজার ৫৩৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তারপরও আবাসিক সংকটের কারণ দেখিয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের গণরুম ও মিনি গণরুমে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, চারুকলা বিভাগ ও ফার্মেসি বিভাগ ছাড়া বাকি বিভাগগুলোতে ৪৫ ও ৪৬তম ব্যাচের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখনো ৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম ব্যাচের প্রায় আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী হলগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। তাদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগ নেতাদের রেফারেন্স দেখিয়ে হলে বাস করছেন। ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির ৪০০ জন পদধারী নেতার মধ্যে ২৭০ জন নেতার ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা কক্ষ দখল করে হলে থাকছেন। তাদের কেউ কেউ চারজনের আসনের একটি কক্ষে দুজন, দুজনের কক্ষে একজন করে থাকছেন। কোনো কোনো হলে চারজনের কক্ষে একজন করে থাকেন। অবৈধভাবে অবস্থান করা এসব শিক্ষার্থীর চাপ পড়ছে বৈধ শিক্ষার্থীদের ওপর। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জায়গা হয়েছে গণরুম ও মিনি গণরুমে। এক কক্ষের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকছেন ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থী। এতে পড়াশোনাসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত ঘটছে শিক্ষার্থীদের। এদিকে ধর্ষণের ঘটনার পরদিন থেকে অভিযুক্তদের শাস্তিসহ ৪ দফা দাবিতে টানা আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

সমাবেশে বক্তারা, কবিতা আবৃত্তি, গান ও বক্তৃতার মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। তাদের অন্য দাবিগুলো হলো- আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান ও প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলমের পদত্যাগ এবং যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত পাবলিক হেল্থ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনিকে অব্যাহতি দেওয়া।

ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও হল না ছাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ৪৫ ব্যাচের একাধিক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ৪৪, ৪৩, ৪২ ব্যাচের অছাত্ররা থাকতে পারলে আমরা কেন হলে থাকতে পারব না? যত দিন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতারা হলে থাকবেন তত দিন আমরাও হলে থাকব।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক হলের প্রাধ্যক্ষ বলেন, ছাত্রলীগেরসহ সব অবৈধ শিক্ষার্থীর হল ত্যাগে প্রশাসন চাইলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ছাত্রলীগের পরামর্শে প্রশাসন হল চালায় বলে তাদের বের করা সম্ভব হচ্ছে না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি এরই মধ্যে কয়েকটি হল পরিদর্শনে গিয়েছি। ছাত্রলীগসহ যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে তাদের হল ছাড়তে বলা হয়েছে। হল প্রশাসনকে হলের আসন বণ্টনসহ অন্য সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই আমরা অছাত্রদের হল থেকে বের করতে পারব।’ অন্যদিকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যবস্থা নিতে তদন্ত চলছে বলে জানান উপাচার্য।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর