দুই দিনের জ্বর নিয়ে তিন বছরের শিশু আরেফাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান মা। চিকিৎসক সাধারণ জ্বরের সিরাপ লিখে দেন। পরে রোগীর মা চিকিৎসকের কাছে একটি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিতে আবদার করেন। চিকিৎসক তা করেননি। পরে আবার বলেন, প্রেসক্রিপশনের পেছনে হলেও যেন একটা অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন। তাতেও অসম্মতি জানান চিকিৎসক। এভাবে রোগী কিংবা রোগীর অভিভাবকই স্বপ্রণোদিত হয়ে চিকিৎসকের কাছে অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেওয়ার আবদার করেন। যেন অ্যান্টিবায়োটিকেই রোগ নিরাময়ের মূল চিকিৎসা। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারও হচ্ছে। ফলে পর্যায়ক্রমে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকের। বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকরাও চরমভাবে উদ্বিগ্ন। ফার্মেসিগুলোতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই দেদার বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক।
চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (সিআইএমসিএইচ) উপাধ্যক্ষ শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুসলিম উদ্দিন সবুজ বলেন, গত সোমবার চেম্বারে আমি অর্ধশত রোগী দেখেছি। অনেকেরই মৌসুমি জ্বর ছিল। ওইদিন শুধুমাত্র তিনজনকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছি। এর মধ্যে অনেকেই আবদার করছেন যেন ব্যবস্থাপত্রে একটা অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিই। আমি পাঁচ থেকে সাত দিনের কম জ্বর হয়েছে এমন কাউকে অ্যান্টিবায়োটিক দিইনি। এখন যাদের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় তাদের নামটা লাল কলম দিয়ে লিখে রাখি।
জানা যায়, সিআইএমসিএইচের ফার্মাকোলজি বিভাগের চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানাধীন এলাকার ৫০টি ফার্মেসিতে পরিচালিত এক গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ভয়াবহ তথ্য বের হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ৪৪ শতাংশ ওষুধ বিক্রেতা অ্যান্টিবায়োটিক সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি। ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ জ্বরের জন্যই ফার্মেসি থেকে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় এজিথ্রোমাইসিন-৪৪ শতাংশ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিক্রি হয় সিপ্রোফ্লক্সাসিন। ৩৬ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীরা ওষুধ বিক্রেতাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চাপ দেন। তাছাড়া, ৫০টি ফার্সেমির মধ্যে ৪৭টিতেই প্রাতিষ্ঠানিক সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট নেই। এভাবে ফার্মেসিতেই সর্বনাশ হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকারিতা। গবেষণাটি পরিচালনা করেন সিআইএমসিএইচের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. মোহাম্মদ রাকিব হাসান। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মানবজাতির বড় বিপর্যয়ের কারণ। দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে অচিরেই মানবজাতি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, পল্লী চিকিৎসক ও গ্রামের ফার্মেসিতে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি, গ্রহণ, যথাযথ ডোজ ও সময়কাল মেনে না চলায় এর কার্যকারিতা হারাচ্ছে।তাই মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় এখনই প্রয়োজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করা, সরকারি তদারকি বৃদ্ধি ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ফার্মেসিতে ডিগ্রিধারি ফার্মাসিস্ট রাখা, সর্বত্র মডেল ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা, ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে জাতীয়ভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে গবেষণা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৯ সালে বিশ্বে ৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন লোক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে মারা গেছেন। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে প্রতি বছরে ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। শুধু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণেই আগামীতে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন মারা যাবেন।