শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা
বিশ্ব আবহাওয়া দিবস আজ

বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার ধরন-বৈশিষ্ট্য

চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে বর্ষা আসছে দেরিতে যাচ্ছেও দেরিতে, হারাতে বসেছে শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশের আবহাওয়ার ধরন ও বৈশিষ্ট্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা এ পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও নরওয়ের আবহাওয়া দফতরের পাঁচ আবহাওয়াবিদ যৌথ গবেষণাও করেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত সেই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, দেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বিস্তৃত হচ্ছে। বর্ষা আসছে দেরিতে, যাচ্ছেও দেরিতে। তাপপ্রবাহের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্ষা, শীত ও গ্রীষ্মে তাপ বেড়ে যাচ্ছে। শীতের দিনে তাপ বাড়লেও ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে বেশি। মেঘাচ্ছন্ন দিনের সংখ্যাও বাড়ছে।

আবার ষড়ঋতুর বাংলাদেশ এখন বৈচিত্র্যহীন। ঋতুগুলো হারাতে বসেছে তার স্বাভাবিক আচরণ। ঋতু বৈচিত্র্যের এই দেশে প্রতি দুই মাসকে একটি ঋতু হিসেবে ধরা হলেও কয়েকটি ঋতু এরই মধ্যে তার বৈচিত্র্য হারিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো শীত ও গ্রীষ্মপ্রধান দেশ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। প্রকৃতিতে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুর অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত এ তিনটি ঋতু কখন আসে আর কখনইবা চলে যায় টের পাওয়া যায় না। আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণে হুমকিতে পড়ছে জনজীবন ও জীববৈচিত্র্য। বাড়ছে রোগবালাই, ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। এ অবস্থায় আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব আবহাওয়া দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অ্যাট দ্য ফ্রন্টলাইন অব ক্লাইমেট অ্যাকশন’। চলতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও নরওয়ের আবহাওয়া দফতরের যৌথ গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে মৌসুমিভিত্তিক আবহাওয়ার ধরন দ্রুত বদলাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। ‘বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু : আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের প্রবণতা এবং পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, রাজশাহী অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাপপ্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ভবিষ্যতে বৃষ্টির সময়ও কমে আসতে পারে। হঠাৎ অস্বাভাবিক বৃষ্টি হতে পারে। ক্রমেই জলবায়ু পরিস্থিতি উষ্ণ হচ্ছে। সব ঋতুতেই তাপমাত্রা আগের চেয়ে বাড়ছে। ঢাকার তাপমাত্রার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৪০ বছরে প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী তিন সময়েই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৯, শূন্য দশমিক ৩৩ এবং শূন্য দশমিক ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। শুধু শীতকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমে গেছে শূন্য দশমিক ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে ৪টি কালেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে। গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ। এ প্রসঙ্গে তিনি  বলেন, দেশে সিজনাল প্যাটার্ন বদলে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাচ্ছে। দাবদাহের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে। সারা দেশেই এটি বাড়ছে। শীতেও স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ছাড়া আন্তমহাদেশীয় দূষণের কারণে দিনের তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। শীতে বেশি ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। এই দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব পড়বে কৃষিতে। সেচের জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে। এসি লাগবে বেশি। সাধারণত তাপপ্রবাহ দেখা যেত গ্রীষ্মকালে-এপ্রিল ও মে মাসে। এখন অক্টোবর পর্যন্ত চলে গেছে। আগে গ্রীষ্মকালে যে দাবদাহ হতো গত ১২ বছর থেকে দেখা যাচ্ছে এটি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। শুধু গ্রীষ্মকালে নয়, এটা বর্ষাকালেও হচ্ছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ দেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখতে পায়, সেখানে ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ছে না। গ্রীষ্মকাল ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বর্ষাকাল তার সময় থেকে সরে যাচ্ছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা হচ্ছে না। আষাঢ় মাস বৃষ্টিহীন থাকলেও ভাদ্র-আশ্বিনে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। শরৎ এলেও কাশফুল ও শিউলি চোখে পড়ছে না। হেমন্ত ও বসন্ত হারিয়ে যাচ্ছে। শীতকালের ব্যাপ্তি কমে আসছে। এ গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ষড়ঋতুর দুটি ঋতু- হেমন্ত ও বসন্ত প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। শীতকালের সময় ও ব্যাপ্তি কমে আসছে। এমনটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। 

আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে এখন অস্বাভাবিক বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে অসহনীয় গরমে হাঁসফাঁস করছে প্রাণিকুল। তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে অসময়ে দেখা দিচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। প্রতি মাসে একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ছে দেশ।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আগে দেশে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও বৃষ্টিশূন্যতা দেখা যেত না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন এগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের সময় ও ধরনে পরিবর্তন এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যখন আমরা দেখি যে দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন ধরে নিতে হবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হচ্ছে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আতিক রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে প্রতি ১০ বছরে একটি বড় ঘূর্ণিঝড় হতো। এখন প্রতি দুই-তিন বছরে বড় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া তাপমাত্রা ও ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনও চোখে পড়ছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন হচ্ছে না। যখন হওয়ার কথা না তখন হচ্ছে।

 

 

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর